৩৪ বছরের শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে গেলেন অন্যরকম ভালোবাসায়
শিক্ষকতা জীবনের ৩৪ বছরে কখনোই হযরত আলী বাড়ি থেকে সকাল ৯টার পরে বিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হননি। তবে গতকাল বুধবারের সকালটা ছিল ভিন্ন রকম। প্রিয় সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরা ছুটে আসেন তাঁর বাড়িতে। তাঁদের অনুরোধে বাড়ি থেকে বের হন সকাল সাড়ে ১০টায়। ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে করে তাঁকে নেওয়া হয় দীর্ঘদিনের কর্মস্থলে। সেখানে অপেক্ষমাণ শত শত শিক্ষার্থী তাঁকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়। সহকর্মী-শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হন তিনি।
সদ্য অবসরে যাওয়া নাটোরের লালপুর উপজেলার গৌরীপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হযরত আলীকে বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ঘিরে চলে এমন আয়োজন। কাগজে-কলমে গত ১৯ অক্টোবর তিনি অবসর নিলেও গতকাল তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম বলেন, এটা সাধারণ কোনো বিদায় অনুষ্ঠান ছিল না। শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের পাশাপাশি এলাকার সর্বসাধারণের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি ভিন্নমাত্রা পায়।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় গৌরীপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে চামটিয়া গ্রামের বাড়ি থেকে প্রিয় শিক্ষক হযরত আলীকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আনতে যান তাঁর সহকর্মীরা। সুসজ্জিত মোটরশোভাযাত্রা নিয়ে তাঁকে যখন কলেজ চত্বরে আনা হয়, তখন শিক্ষার্থী ও অতিথিরা দাঁড়িয়ে ফুল ছিটিয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানান। তিনিও সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। খোলা মাঠের বিশাল মঞ্চে ফুলের মালা গলায় দিয়ে তাঁকে বসানো হয়। বিদায়ের মুহূর্ত স্মরণীয় করে রাখতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছবি তোলা হয়। সেই অনুষ্ঠানে শিক্ষক হযরত আলীর পরিবারের সদস্যরাও আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। একপর্যায়ে মঞ্চে শুরু হয় তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা। সবার কণ্ঠে তাঁর ন্যায়নিষ্ঠ শিক্ষকতার কথা উঠে আসে। স্মৃতিচারণার মুহূর্তে কেউ কেউ আবেগে আপ্লুত হয়ে কাঁদলেন। আবার কেউবা হলেন উচ্ছ্বসিত।
শিক্ষার্থী তাসনিম জান্নাত জানায়, শিক্ষক হযরত আলী একজন আদর্শ শিক্ষার্থীর দিনপঞ্জি শিখিয়েছেন, যা অনুসরণ করে নিজেকে বদলে ফেলার চেষ্টা করছে। শিক্ষার্থী ফারহানা হক ও সজীব আলী জানায়, বিদায়ী শিক্ষকের কাছ থেকে শ্রেণিকক্ষে পড়ালেখার বাইরেও তারা অনেক কিছু শিখেছে।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী মিজানুর রহমানের ভাষ্য, শত ব্যস্ততার মধ্যেও শিক্ষক হযরত আলী সব সময় হাসিমুখে কথা বলতেন। শাসন দিয়ে নয়, হাসিমাখা কথা দিয়ে তিনি পড়ালেখার প্রতি সবাইকে মনোযোগী করতেন।
শিক্ষক হযরত আলীর সঙ্গে ২৭ বছর শিক্ষকতা করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক শিক্ষক গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী। তিনি বলেন, হযরত আলী সবার আগে প্রতিষ্ঠানে আসতেন, সবার পরে যেতেন।
শিক্ষক হারুন অর রশিদের মতে, ‘একজন প্রশাসক (অধ্যক্ষ) হিসেবেও হযরত আলী স্যার ছিলেন আপাদমস্তক সৎ ও নির্ভীক। তিনি প্রতিষ্ঠানের হিসাবের খাতা ও রেজল্যুশন বই সবার জন্য উন্মুক্ত করে রাখতেন।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ বলেন, রাজনৈতিক চাপাচাপিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়েন। কিন্তু হযরত আলী বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিষয়টি কাটিয়ে নিতেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা চিকিৎসক ইয়াসির আরসাদ বলেন, ‘শিক্ষককে বিদায় জানানোর কিছু নেই। একজন শিক্ষক আজীবন জ্ঞান দান করে যান।’ অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নুরুজ্জামান বলেন, তিনি সর্ব সাধারণের কাছে শিক্ষক হযরত আলী সম্পর্কে ভালো ধারণা পেয়েছেন। তিনি ক্লাসের পড়ালেখার বাইরেও শিক্ষার্থীদের নীতি-নৈতিকতা শিখিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেহদী হাসান বলেন, একজন শিক্ষক হিসেবে ও একজন প্রশাসক হিসেবে অধ্যক্ষ হযরত আলী সফল ব্যক্তি। তাঁর হিসাব–নিকাশের সচ্ছতা ও পাঠদানের একাগ্রতা তাঁকে মুগ্ধ করেছে।
হযরত আলী বলেন, তিনি এই প্রতিষ্ঠানে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। ১৯৯০ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৭ সালে প্রধান শিক্ষক, পরে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৩৪ বছরের কর্মজীবনে তিনি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকে বড় করে দেখেছেন। শাসন করে নয়, অনুরোধ করে সবার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিয়েছেন।