তিন বছরের ছেলে ও স্ত্রী দগ্ধ হওয়ার খবর শুনেই দেশের পথ ধরেন দুবাইপ্রবাসী সিরাজুল মোস্তফা। দুবাই বিমানবন্দরে এসে ফ্লাইটের অপেক্ষার সময় খবর পান, আদরের ছেলে আয়ান মারা গেছে। দেশে এসেই হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে ছোটেন দাফনের জন্য। ছেলের লাশ দাফন করে হাসপাতালে এসে শোনেন, মারা গেছেন স্ত্রীও।
প্রবাসী সিরাজুল মোস্তফার বাড়ি কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়নের মাইজপাড়ায়। গত বৃহস্পতিবার দেশে আসেন তিনি। আজ মঙ্গলবার সকালে বাড়িতে বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বাড়ির বসার ঘরে স্ত্রী ও শিশুসন্তানের ছবি হাতে বসে ছিলেন সোফায়। ছবিতে হাত বুলাতে বুলাতে কেঁদে চলেছেন অঝোরে। অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘ভাই, সব শেষ হয়ে গেল। একজনের চিকিৎসা করাতে গিয়ে এতগুলো মানুষ মারা গেল। এই ছিল আমার কপালে? আমার ছেলেকে ছাড়া আমি কীভাবে বাঁচব। আমার ছোট্ট ছেলেটা কবরে একা কীভাবে থাকবে।’
১০ জুন সন্ধ্যায় বসুন্ধরা আবাসিকের একটি বাসার কক্ষে এসি বিস্ফোরণে সিরাজুলের ছেলে মোহাম্মদ আয়ান (৩), শ্বশুর আবদুল মান্নান (৫৫), স্ত্রী রুক্সি আক্তার (২২) ও শ্যালিকা পুতু আক্তার (২০) দগ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে প্রথমে এভারকেয়ার হাসপাতালে, পরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।
এর মধ্যে বুধবার শিশু আয়ান ও বৃহস্পতিবার বিকেলে পুতু আক্তার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। শনিবার দুপুরে মারা যান আয়ানের নানা আবদুল মান্নান। সর্বশেষে গত রোববার ভোর পাঁচটার দিকে মারা যান শিশু আয়ানের মা রুক্সি আক্তার।
আয়ানের মা রুক্সি আক্তারের চিকিৎসা করাতেই তাঁরা ঢাকায় আসেন। ৬ জুন বসুন্ধরায় একটি হাসপাতালে রুক্সির মস্তিষ্কে টিউমারের অস্ত্রোপচার হয়। ১০ জুন রুক্সি ছেলে, বাবা আবদুল মান্নান ও বোন পুতু আক্তারকে নিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় সাবলেট হিসেবে ওঠেন। সেদিন সন্ধ্যায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
পারিবারিক সূত্র জানায়, ময়নাতদন্ত শেষ করে বাবা আবদুল মান্নান ও মেয়ে রুক্সি আক্তারের লাশ ঈদের দিন সোমবার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। পরে আসরের নামাজের পর পুরান বাজার মাঠে তাঁদের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়েছে। এর আগে গত শুক্রবার রাত তিনটার দিকে ঢাকা থেকে শিশু আয়ান ও তার খালা পুতু আক্তারের লাশ বাড়িতে আনা হয়। পরদিন শনিবার সকাল ১০টায় স্থানীয় মাদ্রাসার মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
আয়ানের বাবা প্রবাসী সিরাজুল মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আয়ানের মারা যাওয়ার খবর আমাকে প্রথমে জানানো হয়নি। এর মধ্যে ফেসবুকে আয়ানের মৃত্যুর খবর দেখে বাড়িতে ফোন দিয়েছিলাম। এরপর আমাকে তারা জানায়। এরপর বৃহস্পতিবার দেশে ফিরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখি আয়ানের লাশ। পরে হাসপাতালে কথা হয় আমার স্ত্রীর সঙ্গে। সে আমাকে বলে, কপালে সুখ বেশি দিন টিকল না। আল্লাহ তাদের নিয়ে যাচ্ছে। সেটাই ছিল শেষ কথা। আয়ান ও তার খালার লাশ দাফন করে হাসপাতালে পৌঁছে শুনি, আমার স্ত্রীও মারা গেছে।’
সিরাজুল মোস্তফার বাড়ি থেকে অন্তত এক কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে তিতামাঝির পাড়া এলাকায় তাঁর শ্বশুরবাড়িতেও চলছে আহাজারি। এবারে ঈদ আনন্দ নেই তাঁদের পরিবারেও।