‘শুধু একবার মায়ের মুখটা দেখতে চাই’
‘আমার মা আর ছেলে দুজনই নদীতে ডুবে যায়। ছেলে ফিরে এলেও মাকে এখনো পেলাম না। আমি শুধু একবার মায়ের মুখটা দেখতে চাই।’ কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাকোয়া বাজারের পল্লিচিকিৎসক দীপক চন্দ্র বর্মণ। বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকার করতোয়া নদীতে গতকাল রোববার দুপুরের নৌকাডুবিতে এখন পর্যন্ত ৩৩ জনের লাশ উদ্ধার করা গেছে। নিখোঁজের তালিকায় আছেন ৫৮ জন। সেসব নিখোঁজ মানুষের একজন দীপক চন্দ্রের মা আদুরী রানী (৪৮)।
কদিন বাদেই বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। দেবীপক্ষের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে দুর্গাপূজার ক্ষণগণনা। এ উপলক্ষে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেজেগুজে অপেক্ষা করতে থাকেন আদুরী রানী ও তাঁর নাতি তন্ময় (৯)। দুপুর ১২টার দিকে মধ্যাহ্নভোজন সেরেই বদেশ্বরী মন্দিরের মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বেরিয়ে পড়েন তাঁরা। আউলিয়া ঘাটে এসে তড়িঘড়ি করে ভিড়ের মধ্যেই নৌকায় ওঠেন তাঁরা। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষ থাকায় কিছুদূর যেতেই দুলতে থাকে নৌকাটি। শুরু হয় চিৎকার-চেঁচামেচি আর আর্তনাদ। দেখতে দেখতে ডুবে যায় নৌকাটি। শিশু তন্ময়কে উদ্ধার করা গেলেও নদীতে তলিয়ে যান আদুরী রানী।
মায়ের খোঁজে আজ সোমবার ভোরে করতোয়াপাড়ে ছুটে আসেন দীপক চন্দ্র বর্মণ। একটি নৌকা ভাড়া করে ভাটির দিকে যেতে থাকেন। কিন্তু খুঁজে না পেয়ে আবার ঘাটে ফিরে আসেন। সকাল ১০টার দিকে তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদকের কথা হয়। দীপক বলেন, নৌকাডুবির খবর পেয়ে ঘাটে ছুটে আসেন তিনি। এসেই মা ও ছেলেকে খুঁজতে শুরু করেন। ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর তাঁর এক প্রতিবেশী এসে জানান, তন্ময়কে উদ্ধার করা হয়েছে। ও বাড়ি চলে গেছে। শুনেই বাড়ি ফিরে আসেন দীপক। এসে দেখেন ছেলে ফিরেছে, কিন্তু মা নেই। আবার ছুটে আসেন করতোয়াপাড়ে। দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন, কিন্তু মায়ের সন্ধান পাননি। রাত পর্যন্ত অপেক্ষার পর ফিরে আসেন বাড়িতে। ভোর হলে আবার করতোয়াপাড়ে যান।
দীপক চন্দ্র বলেন, ‘আমার মা-ছেলে একই সঙ্গে নদীতে ডুবে গিয়েছিল। ছেলেকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু মাকে এখনো পেলাম না। জানি না তিনি জীবিত, না মৃত। মা নিখোঁজ না হয়ে যদি ছেলে নিখোঁজ হতো, তাহলে মানুষ হয়তো নানা কটু কথা বলত। তারা হয়তো বলত, দাদির সঙ্গে গিয়েই তন্ময়ের মৃত্যু হয়েছে। সে কারণে হয়তো মা তাঁর স্নেহের তন্ময়কে উদ্ধারের জন্য কারও হাতে তুলে দিয়ে নিজেই হারিয়ে গেছেন।’
দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের হাতিডোবা গ্রামের গুরু দয়াল বর্মণের ভাতিজি তনুশ্রী (৬) নৌকাডুবিতে মারা যায়। সে সময় নিখোঁজ হয় গুরু দয়ালের আরেক ভাতিজি দোলা (৫)। আজ তার খোঁজে নদীর পাড়ে আসেন গুরু দয়াল। তিনি বলেন, ‘তনুশ্রী আর দোলাকে বাড়ির সবাই খুবই স্নেহ করত। তনুশ্রীকে হারিয়ে স্বজনেরা যখন সবাই বাকরুদ্ধ, তখন দোলার লাশ উদ্ধার হলে কী যে হবে ভাবছি।’
বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোলেমান আলী বলেন, গতকালের নৌকাডুবির ঘটনায় আজ দুপুর পর্যন্ত ৩৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি শিশু। আর ৫৮ জন এখনো নিখোঁজ। নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনেকের লাশ আজ ভেসে উঠছে। তাদের অনেকেই শিশু।