কক্সবাজার সদর হাসপাতালের পশ্চিম পাশের এক কোনায় একতলা ভবনে মর্গ। ভেতরে সারিবদ্ধভাবে রাখা সাদা পলিথিনে মোড়ানো ১০টি লাশ। বাইরে অপেক্ষায় আছেন বেশ কিছু মানুষ। তাঁরা এসেছেন লাশ নিয়ে যেতে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় লাশ হস্তান্তর করা হচ্ছে না।
আজ সোমবার সকাল ১০টায় হাসপাতালে গিয়ে এই চিত্র দেখা যায়। সেখানে লাশের অপেক্ষায় থাকা স্বজনেরা বলছেন, গতকাল রোববার বিকেল পাঁচটার দিকে শহরের নাজিরারটেক উপকূল থেকে পুলিশ লাশগুলো উদ্ধার করে হাসপাতালের মর্গে নিয়ে আসে। আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত ময়নাতদন্ত শেষ হয়নি। লাশের জন্য হাসপাতালের প্রাঙ্গণে তাঁদের নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে।
হাসপাতালের মর্গের পাশে বসে ছিলেন মহেশখালীর কয়েকজন নারী-পুরুষ। বেঞ্চের এক পাশে বসে কান্নাকাটি করছিলেন মহেশখালীর শাপলাপুর ইউনিয়নের মিঠাছড়ি গ্রামের জহুরা বেগম। কিছুক্ষণ পরপর তিনি মুঠোফোনে লাশ পেতে বিলম্বের বিষয়ে কথা বলছিলেন।
জহুরা বেগম (৪০) প্রথম আলোকে বলেন, ডুবন্ত ট্রলার থেকে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা যে ১০টি লাশ উদ্ধার করেছেন, সেখানে তাঁর ছেলে ওসমান গণিও রয়েছে। ট্রলার থেকে উদ্ধারের পর যখন বালুচরে সারিবদ্ধভাবে লাশগুলো রাখা হচ্ছিল, তখন স্বজনেরা ওসমানকে চিনতে পারেন। হাসপাতালের মর্গে আনার পরও ওসমানের পরিচয় জানানো হয় পুলিশকে। কিন্তু ছেলের লাশ হাতে পাচ্ছেন না।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রলারডুবির ঘটনায় নিহত ১০ জনের লাশ গতকাল রোববার বিকেলে মর্গে আনা হলেও সুরতহাল প্রতিবেদন হাতে এসেছে আজ বেলা ১১টার দিকে। সুরতহাল প্রতিবেদন ছাড়া লাশের ময়নাতদন্ত হয় না। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ময়নাতদন্ত শুরু হয়েছে। সঙ্গে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনাও সংগ্রহ করা হচ্ছে। সিআইডি চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকা থেকে ডিএনএ পরীক্ষা করে পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে জমা দেবে।
পুলিশ জানায়, গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে শহরের নাজিরারটেক উপকূলে ডুবন্ত একটি ট্রলার থেকে অর্ধগলিত অবস্থায় ১০টি লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত ব্যক্তিরা মহেশখালী ও চকরিয়ার বাসিন্দা। ডুবে যাওয়ার ট্রলারের মালিক মহেশখালীর বাসিন্দা সামশুল আলম। নিহত ১০ জনের মধ্যে সামশুল আলমও রয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত পুলিশ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি।
চকরিয়ার কোনাখালী থেকে মর্গে এসেছেন জসিম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। ট্রলার থেকে উদ্ধার ১০ লাশের মধ্যে তাঁর ছেলে তারেক রয়েছেন জানিয়ে জসিম উদ্দিন বলেন, গতকাল রোববার বিকেলে খবর পেয়ে তিনি নাজিরারটেক উপকূলে গিয়ে লাশের সারিতে ছেলেকে শনাক্ত করেন। সেই থেকে হাসপাতালের মর্গে অবস্থান করছেন। কিন্তু ছেলের লাশ পাচ্ছেন না।
মর্গে নিহত সামশুল আলমের (ট্রলারমালিক) পরিচয় শনাক্ত করেন তাঁর স্ত্রী রোকেয়া আক্তার। তিনি বলেন, চেহারা বিকৃত হলেও পরনের পোশাক দেখে তিনি সামশুল আলমকে চিনতে পেরেছেন। কিন্তু পুলিশ লাশ দিচ্ছে না। এখনো লাশের ময়নাতদন্তও হয়নি।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, মহেশখালী ও চকরিয়ার অনেকে এসেছেন লাশ নিয়ে যেতে। কিন্তু অর্ধগলিত লাশগুলোর পরিচয় যথাযথভাবে শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে। এখন ময়নাতদন্তের সঙ্গে ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। ডিএনএ প্রতিবেদন হাতে না আসা পর্যন্ত লাশগুলো হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হতে পারে।
পিবিআইয়ের প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত আইজি বনজ কুমার মজুমদার গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, নিহত ১০ জেলের প্রাথমিক পরিচয় শনাক্ত করে পিবিআই। নিহত জেলেদের মধ্যে ছয়জন মহেশখালী উপজেলার শাপলাপুর ইউনিয়নের মিঠাছড়ির বাসিন্দা। একজনের বাড়ি একই উপজেলার কালারমারছড়া গ্রামে এবং অপর তিনজনের বাড়ি চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী গ্রামে। নিহত জেলেরা সবাই ৭ এপ্রিল মাছ ধরার একটি ট্রলার নিয়ে সাগরে নেমেছিলেন। সেখানে জেলেদের বরফ রাখার কক্ষে আটকে রেখে ট্রলারটি ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।
নিহত জেলেরা হলেন মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের ছনখোলাপাড়ার রফিক মিয়ার ছেলে সামশুল আলম (২৩), শাপলাপুর ইউনিয়নের মিটাছড়ি গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে সাইফুল ইসলাম (১৮), জাফর আলমের ছেলে শওকত উল্লাহ (১৮), মুসা আলীর ছেলে ওসমান গণি (১৭), সাহাব মিয়ার ছেলে সাইফুল্লাহ (২৩), মোহাম্মদ আলীর ছেলে পারভেজ মোশাররফ (১৪), মোহাম্মদ হোসাইনের ছেলে নুরুল কবির (২৮) এবং চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নের কবির হোসাইনের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৩৪), শাহ আলমের ছেলে মোহাম্মদ শাহজাহান (৩৫) ও চকরিয়া পৌরসভার চিরিঙ্গা এলাকার জসিম উদ্দীনের ছেলে তারেক জিয়া (২৫)।