বগুড়া সদর
বন্ধুত্ব থেকে পরস্পরের শত্রু
রাজনীতি ও আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে গত সোমবার স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতাকে কুপিয়ে এবং যুবদলের এক কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
একই গ্রাম, পাশাপাশি বাড়ি। মিজানুর রহমান (৪০) ও সুমন আহমেদ ওরফে বিপুল মিয়া (৩৫) বয়সের ব্যবধান বছর পাঁচেকের। দুজনের জন্মই দরিদ্র পরিবারে। মিজানুরের বাবা ছিলেন নার্সারি কর্মচারী। বিপুলের বাবা গরু কেনাবেচার মধ্যস্থতাকারী (দালাল)। এক দশক আগেও মিজানুর নার্সারিশ্রমিক ছিলেন, বিপুল দিনমজুর। দুজনের সখ্যও ছিল নিবিড়।
মিজানুরের হাত ধরেই বিএনপির রাজনীতিতে আসেন বিপুল। ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে তাঁরা সক্রিয় ভূমিকা রেখে নজরে পড়েন বিএনপি নেতাদের। দুজনই পেয়ে যান স্বেচ্ছাসেবক দলের পদপদবী। ক্ষমতার বাইরে থেকেও দুজন নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। গড়ে তোলেন বাহিনী। বগুড়া সদরের বাঘোপাড়া থেকে গোকুল, মহাস্থানগড় ও চন্ডিহারা পর্যন্ত অপরাধের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নেন। ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে বাধে দ্বন্দ্ব। তৈরি হয় দূরত্ব। আলাদা হয়ে যান তাঁরা। গড়ে তোলেন আলাদা বাহিনী। বন্ধুত্ব থেকে হয়ে যান পরস্পরের শত্রু।
গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পালাবদলে একক আধিপত্য নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন মিজানুর ও বিপুল। সোমবার রাত ৯টার দিকে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে গোকুল ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সংলগ্ন মাজারের পাশে হামলা হয় মিজানুরের ওপর। কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে। পালানোর সময় প্রতিরোধের মুখে পড়ে বিপুল বাহিনী। কোনোরকমে অন্যরা প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারলেও ধরা পড়েন বিপুলের চাচাতো ভাই যুবদল কর্মী সানোয়ার হোসেন (ল্যাদো)। পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে।
বন্ধু থেকে শত্রু–শত্রু খেলা
মিজানুর ও বিপুলের বাহিনীতে একসময় কাজ করতেন, এমন দুজনের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা জানান, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও দখল বাণিজ্যের অর্থকড়ি ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে ২০১৫ সালের দিকে মিজানুর ও বিপুলের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সেই দ্বন্দ্ব থেকে আলাদা হয়ে যান বিপুল। আলাদা বাহিনী গড়ে তোলেন। বিপুলের দলে ভেড়েন তাঁর চাচাতো ভাই সানোয়ার হোসেনসহ অনেকেই। অন্যদিকে মিজানুরের সঙ্গে থেকে যান সনি রহমান, রাব্বী, জি এমসহ অন্য সহযোগীরা। বিপুল স্বেচ্ছাসেবক দল ছেড়ে যোগ দেন যুবদলে। গোকুল ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়কের পদও পান। মিজানুর পান সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের পদ। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুজনের মধ্যে সংঘাত একসময় চরম আকার ধারণ করে। ঘটে হত্যা ও হামলার ঘটনাও। ২০১৫ সালের ২৯ জুন মহাস্থানগড় এলাকা থেকে অস্ত্রসহ মিজানুর রহমানকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
মিজানুর ও বিপুলের ঘনিষ্ঠজনেরা জানান, ২০১৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গোকুল হল বন্দর এলাকায় ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী ও মিজানুরের ছায়াসঙ্গী সনি রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যা মামলায় বিপুল ছাড়া তাঁর সহযোগী অনেককেই আসামি করা হয়। ওই মামলায় আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে বিপুলের সহযোগী আল মামুনকে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ ওঠে মিজানুর ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে। সনি হত্যার প্রতিশোধ নিতে ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সদরের চণ্ডীহারা খোলাগাছি এলাকায় সনি হত্যা মামলার প্রধান আসামি ও গোকুল ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য আল মামুন এবং তাঁর মাংস ব্যবসায়ী ভাই, বিএনপির সক্রিয় কর্মী আপেল মাহমুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। কুপিয়ে হত্যা করা হয় আপেল মাহমুদকে। জখম করা হয় আপেলের বড় ভাই আল মামুনকে।
মিজান হত্যাকাণ্ডের কারণ
বিপুলের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল, এমন সহযোীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনি হত্যাকাণ্ডের পর আস্তানাছাড়া হয়েছিলেন মিজানুর। পরে তিনি সনি হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতির প্রলোভন দেখিয়ে বিপুলের কাছ থেকে দলে টানেন জনি ও নয়নকে। এতে মিজানুরের ওপর ক্ষুব্ধ হন বিপুল। ৫ আগস্টের পর বিপুল প্রতিপক্ষের বাড়িঘর ভাঙচুর ও দখলে জড়াননি। অথচ ১১ আগস্ট তাঁকে যুবদলের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর পেছনে মিজানুরের হাত আছে বলে সন্দেহ হয় বিপুলের। এ ছাড়া কিছুদিন আগে বিপুলের এক আত্মীয়কে কুপিয়ে আহত করেন মিজানুর ও তাঁর সহযোগীরা। এসব কারণেই মিজানুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
বগুড়া সদর থানার ওসি সাইহান ওলিউল্লাহ বলেন, নিহত মিজানুরের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন ধারায় ২২টি মামলা এবং বিপুলের বিরুদ্ধে হত্যাসহ ৯টি মামলা আছে।