বগুড়ার এশিয়া সুইটস
দুধ–চা থেকে দেশসেরা ‘শাহি দই’
এশিয়া সুইটসে বর্তমানে ২৫ পদের বিশেষ মিষ্টি এবং চার ধরনের সাধারণ মিষ্টি উৎপাদিত হয়। বিশেষ মিষ্টি প্রতি কেজির দাম ৬০০ এবং সাধারণ মিষ্টির দাম এখানে ২৮০ টাকা। এ ছাড়া শাহি দই প্রতি সরা ২৮০, বিশেষ দই ২৬০ টাকায় বিক্রি হয়।
নূরুল হুদা চিকিৎসক বাবার সঙ্গে তাঁর ডিসপেনসারিতে বসতেন। রোগীর সংখ্যা কমে গেলে ডিসপেনসারি বন্ধ করে সেখানে চা-শিঙাড়ার দোকান দেওয়ার উদ্যোগ নেন তিনি। প্রথমে খাবারের দোকান দেওয়ার পক্ষে সায় ছিল না তাঁর বাবার। ১৯৮৪ সালে একটি ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করেন ছোট পরিসরে চা-শিঙাড়া, নিমকি-মিষ্টি আর পুরি বিক্রির রেস্তোরাঁ। এশিয়া মহাদেশজুড়ে খ্যাতি ছড়াবে—এমন বড় স্বপ্ন নিয়ে রেস্তোরাঁর নাম দেওয়া হয় ‘এশিয়া সুইটস অ্যান্ড কোল্ড ড্রিংকস’। আজ ৩৮ বছর স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে নূরুল হুদার রেস্তোরাঁটি।
এশিয়া সুইটসের সুনাম ও খ্যাতি এখন দেশজুড়ে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও যাচ্ছে এশিয়ার দই-মিষ্টি, ঘি ও লাচ্ছা সেমাই। ‘দইয়ের রাজধানী’খ্যাত বগুড়ার এশিয়া সুইটসের পণ্য এখন সুনাম ছড়াচ্ছে সর্বত্র। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত চলে নানা স্বাদের দই আর হরেক পদের মিষ্টির জমজমাট বেচাবিক্রি। এশিয়ার পণ্য কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন ক্রেতারা। ঈদ-পয়লা বৈশাখের মতো উৎসব-তিথিতে দই-মিষ্টি কেনার জন্য দীর্ঘ লাইনের দৃশ্য চোখে পড়ে হরহামেশা। প্রতিদিন স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এখানকার দই যায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে। ভারত, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশেও ব্যক্তি উদ্যোগে যায় এশিয়ার প্রসিদ্ধ দই-মিষ্টি। বগুড়ায় একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘এশিয়ার দই পাতে না পেলে জামাইয়ের মুখ ভার’।
যাত্রা শুরু থেকে চড়াই–উতরাই পেরিয়ে দীর্ঘ পথপরিক্রমার পেছনের গল্প জানতে এই প্রতিবেদক হাজির হন শহরের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে এশিয়া সুইটসে। নূরুল হুদা ও দুই ভাই এখন ব্যবসা সামলান। সেদিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ছিলেন নূরুল হুদার ছোট ভাই নূরুল বাশার ওরফে চন্দন। তিনি বলেন, এশিয়া সুইটসে প্রতিদিন দুই পালায় কাজ করেন ৫০ জনের মতো বিক্রয়কর্মী। এর বাইরে কারখানায় কারিগর, কারখানা থেকে বিক্রয়কেন্দ্রে মিষ্টি পরিবহনে নিয়োজিত গাড়িচালক, দুধ সংগ্রহকারী, মালামাল কেনাকাটাসহ সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীর সংখ্যা শতাধিক। প্রতিদিন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এশিয়ার কোথাও কোনো শাখা নেই।
এখন তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ২৫ পদের বিশেষ মিষ্টি এবং চার ধরনের সাধারণ মিষ্টি উৎপাদিত হয়। বিশেষ মিষ্টি প্রতি কেজির দাম ৬০০ এবং সাধারণ মিষ্টির দাম এখানে ২৮০ টাকা। এশিয়ায় চার ধরনের লাড্ডু বিক্রি হয়। মতিচূরের লাড্ডুর কেজি এখানে ১৬০ টাকা। এ ছাড়া তিন
ধরনের বিশেষ লাড্ডুর দাম এখানে প্রতি কেজি ৫০০ টাকা। এ ছাড়া শাহি দই প্রতি সরা ২৮০, বিশেষ দই ২৬০, চিনি ছাড়া দই ২৪০ এবং সাদা দই প্রতি ভাড় ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়।
গোড়ার কথা
নূরুল হক ছিলেন সরকারি চিকিৎসক। কর্মস্থল ছিল রংপুর অঞ্চলে। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পরিবার নিয়ে বগুড়ায় ফেরেন। তখন শহরের এডওয়ার্ড পার্ক রোডে দাদা ইসাহাক আলীর ‘ইউনিয়ন মেডিকেল হল’ নামের একটা ডিসপেনসারি ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর সাতমাথা-থানা রোড বা কবি কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে পৈতৃক জায়গায় ওই ডিসপেনসারি স্থানান্তর করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর এটাই ছিল বাম রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আড্ডাস্থল। সত্তর দশকে বগুড়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মুগ্ধতা ছড়ানো কলতান শিল্পীগোষ্ঠী এখানে বসেই প্রতিষ্ঠিত করেন। নূরুল হক ছিলেন সংগঠনটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
নূরুল হকের স্বপ্ন ছিল সন্তানেরাও চিকিৎসক পেশায় ঝুঁকবেন। কিন্তু তা হয়নি। ছয় ছেলে-মেয়ের সবাই ঝুঁকেছেন খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চায়। তিন ছেলের মধ্যে নূরুল আলম ওরফে টুটুল ভলিবল খেলতেন। মেজ ছেলে নূরুল হুদা ওরফে তিলক বাবার সঙ্গে ডিসপেনসারিতে বসতেন। আর সবার ছোট নূরুল বাশার ওরফে চন্দন ফুটবলপাগল।
১৯৮০ সালের পর থেকে ডিসপেনসারিতে ঠিকমতো সময় দিতে না পারায় রোগীও কমে যায়। তখন নূরুল হুদা ডিসপেনসারি বন্ধ করে সেখানে চা-শিঙাড়ার দোকান দেওয়ার উদ্যোগ নেন। রেস্তোরাঁর নাম দেওয়া হয় ‘এশিয়া সুইটস অ্যান্ড কোল্ড ড্রিংকস’।
নূরুল বাশার বলেন, শুরুর দিকে এখানে চায়ের সঙ্গে লুচি, সমুচা, শিঙাড়া ও রসগোল্লা, জিলাপি বিক্রি হতো। তবে অল্প দিনেই খ্যাতি ছড়ায় এশিয়ার গরুর দুধের চায়ের। চায়ের জনপ্রিয়তার জন্যই সকালে নাশতার জন্য ভিড় লাগত। ব্যবসা সামলাতে মেজ ভাই নূরুল হুদার সঙ্গে বড় ভাই নূরুল আলমও যোগ দেন।
নতুন শুরু
১৯৯৩ সালে দুর্ঘটনায় পড়েন নূরুল আলম। একা ব্যবসা সামলাতে তখন হিমশিম অবস্থা নূরুল হুদার। তখন তিনি নূরুল বাশারকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসতে বললেন। বাশার বলেন, উঠতি বয়সী তরুণেরা এই চা খেতে রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা দিতেন। তখন মাদকদ্রব্য বলতে ফেনসিডিলের রমরমা অবস্থা ছিল। তাঁরা ফেনসিডিল পান করে এসে রেস্তোরাঁর কর্মীদের হুকুম করতেন, ‘এই কড়া মিষ্টির চা দে’। এ নিয়ে মেজ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললেন। বুঝলেন, চা বন্ধ না করতে পারলে এ প্রতিষ্ঠান এগোতে পারবে না।
নতুনভাবে প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজাতে শহরের সূত্রাপুর ডা. ইসাহাক আলী লেনে কারখানা স্থানান্তর করা হলো। সেখানে প্রায় ২০ জন কর্মী নিয়ে ১৯৯৩ সালে নতুন আঙ্গিকে অত্যাধুনিকভাবে এশিয়া সুইটস যাত্রা শুরু করল। এবার চা-সমুচা,বা শিঙাড়া নয়, বিশেষায়িত মিষ্টি বিক্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবসা খুললেন। ঢাকা থেকে মিষ্টির কারিগর আনা হয়। অল্প দিনেই এশিয়ার মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
নূরুল বাশার আরও বলেন, মিষ্টির ব্যবসা করতে গিয়ে একসময় মাথায় ভাবনা আসে, দইয়ের রাজধানী বগুড়া। এই দইকে নতুন স্বাদে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। ২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করে এশিয়ার দই। শুরুতে শুধু দিনে ৭০-৮০টি স্পেশাল দইয়ের সরা বিক্রি হতো। মিষ্টির মতো এশিয়ার দইও সাড়া ফেলে। এর মধ্যে একদিন রিয়াজ উদ্দিন নামের একজন কারিগরকে বললেন, এমন একটা ভিন্ন স্বাদের দই তৈরি করেন, যা দইয়ের প্রচলিত ধারণা পাল্টে দেবে। ২০০৬ সালে তাঁর হাতেই উৎপাদন শুরু হয় এশিয়ার শাহি দইয়ের। এটা বগুড়া অঞ্চলে ভুনা দই হিসেবেও পরিচিত। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বাণিজ্যিকভাবে বছরজুড়ে লাচ্ছা সেমাই উৎপাদন শুরু হয় ২০১২ সালে। বর্তমানে এশিয়া ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা এবং ডালডায় ভাজা লাচ্ছা সেমাই উৎপাদন করছে।
এশিয়া সুইটসের উদ্যোক্তা নূরুল হুদা বলেন, এশিয়া সুইটসের দই নানাভাবে দেশের বাইরে যাচ্ছে। নেপাল ও ভারতের বাণিজ্য মেলাতেও রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে এশিয়ার দই বিক্রি হয়েছে। নানাজনের মাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দেশে এশিয়ার দই বিচ্ছিন্নভাবে পাঠানো হচ্ছে। বিদেশিরাও বগুড়ায় এসে এশিয়ার দই কিনছেন। তবে সংরক্ষণ জটিলতার কারণে তাঁরা সরাসরি এখনো দেশের বাইরে দই রপ্তানি করতে পারছেন না। বগুড়ায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু হলে এবং বিদেশে দই রপ্তানিতে সরকার প্রয়োজনীয় সহায়তা দিলে বগুড়ার প্রসিদ্ধ এ পণ্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদেশে নিয়মিত রপ্তানি সম্ভব।
আর নূরুল বাশার বলেন, এশিয়ার পণ্যের বিশেষত্ব হলো ‘খাঁটি দুধের আসল পণ্য’। শুরু থেকেই মানের সঙ্গে এশিয়া আপসহীন। এ কারণে ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত শাখা খোলা হয়নি। কারণ, প্রতিষ্ঠানের পরিধি আরও বেড়ে গেলে মান ঠিক রাখা কঠিন হবে। এ কারণে রাতে তৈরি দই-মিষ্টি দুপুরের আগে এবং সকালে তৈরি দই-মিষ্টি সন্ধ্যার মধ্যেই ফুরিয়ে যায়। কিন্তু এখন ভেজাল দুধের কারণে দই-মিষ্টির উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্বাদ ও মান কমছে। বাজার সয়লাব ভেজাল দুধে। দই-মিষ্টান্ন শিল্পকে বাঁচাতে হলে দুধে ভেজাল ঠেকাতে হবে।