বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে গত তিন দিন ভোলায় থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। পানি জমে রাস্তাঘাট কাদায় একাকার হয়েছিল। সবার মনে ছিল শঙ্কা, ঝুম বৃষ্টি শুরু হলে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান হবে তো! কিন্তু আজ শনিবার সকালে ঝলমলে রোদ উঠে সব শঙ্কা দূর করে দেয়। আকাশে কালো মেঘ দূর হয়ে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে বেড়াতে থাকে। এর মধ্যেই জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তন এলাকা কৃতী শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। এখানেই আজ উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম শিখোর পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রথম আলোর আয়োজনে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
ভোলার চরফ্যাশন, লালমোহন উপজেলাসহ দূরদূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবকের সঙ্গে কাকডাকা ভোরে গাড়িতে করে চলে আসে। মনপুরার শিক্ষার্থী আসে আগের রাতে। সকাল আটটার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হইহুল্লোড়ে অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। অনুষ্ঠানে ভোলার সাত উপজেলার জিপিএ-৫ পাওয়া তিন শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেয়। সকাল ৯টায় তাদের নিবন্ধন শুরু হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা ক্রেস্ট ও স্ন্যাকস সংগ্রহ করে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে গল্প-আড্ডায় মেতে ওঠে। কেউ সেলফি তোলে, কেউ কেউ ফটোফ্রেমের ভেতর দাঁড়িয়ে হাসিমুখে ছবি তোলে। কেউ ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে। মাইক হাতে কেউ গান গায়, কেউ কবিতা পাঠ করে। অনুষ্ঠানের মূল মিলনায়তনের বাইরে দোতলায় অভিভাবকেরা বসার ব্যবস্থা করা হয়। তাঁরা বিনা মূল্যে শনিবারের প্রথম আলো পত্রিকা পড়েন।
সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে মিলনায়তন কানায় কানায় ভরে যায়। ১০টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে গলা মেলান শিক্ষার্থী ও অতিথিরা। জাতীয় সংগীত শেষ হওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ছাত্র-জনতার প্রতি সম্মান জানাতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
বন্ধুসভার উপদেষ্টা মশিউর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর ভোলা প্রতিনিধি মো. নেয়ামতউল্যাহ। প্রথম আলোর পটুয়াখালী প্রতিনিধি শংকর দাস শিক্ষার্থীদের শপথবাক্য পাঠ করান। তিনি মিথ্যা, মুখস্থ ও মাদককে ‘না’ বলা এবং মা, মাটি, মাতৃভূমি দেশকে ‘হ্যাঁ’ বলার অঙ্গীকার করান। শংকর দাস এই আয়োজনকে মেধাবীদের উৎসব উল্লেখ করে বলেন, ‘তোমাদের কৃতজ্ঞ মানুষ হতে হবে। পরিবার, প্রতিবেশী, জন্মভূমি, দেশ ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ হলে মহান মানুষ হতে পারবে।’
অতিথিদের মধ্যে ছিলেন ভোলা সরকারি কলেজের শিক্ষক সাবেক অধ্যক্ষ পারভীন আখতার, পর্বতারোহী এম এ মুহিত, জেলা প্রশাসনের আরডিসি নাদির শাহ নাদিম, ভোলা সরকারি কলেজের প্রভাষক মো. এরশাদ প্রমুখ।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে পর্বতারোহী এম এ মুহিত তাঁর দুইবারের এভারেস্ট বিজয়ের অভিজ্ঞতা ভাগ করে বলেন, ‘তোমরা কেউ চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী, শিক্ষক, প্রধানমন্ত্রী, উদ্যোক্তা কিংবা খেলোয়াড় হতে চাও। যে যা–ই হতে চাও না কেন, সে তার সর্বোচ্চ লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। এতে তুমিও তোমার লক্ষ্যে “এভারেস্ট” বিজয়ী হতে পারবে। তবে সবার আগে মানুষ হতে হবে। “মানুষ হিসেবে এভারেস্ট জয়” করা খুব জরুরি।’
সাবেক অধ্যক্ষ পারভীন আখতার বলেন, ‘এখান থেকে যা শুনবে, তা ধারণ করবে, লালন করবে। আত্মপ্রত্যয় দৃঢ় হতে হবে। অহংকারী হওয়া চলবে না। আত্মমর্যাদাবোধ বাড়াতে হবে। মানুষ হতে হবে। তোমাদের লক্ষ্য ঠিক করতে হবে এবং লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।’
কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে চরফ্যাশন উপজেলার রেসিডেন্সিয়াল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আবদুল আল রাফি বলে, ‘সবাই পৃথিবীর পরিবর্তনে অংশ নিতে পারে না। পৃথিবীর পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে চিন্তা করতে হবে। তবেই আমরা পৃথিবীর পরিবর্তনে অংশ নিতে পারব।’
ভোলা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থী ইফরাত জাহান বলে, ‘ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল ভালো ফল করব। সেভাবেই পড়ালেখা করেছি, করছি। করোনার সময়ে প্রথম আলোর পড়াশোনা পাতা, শিখোর অনলাইন ফ্রি ক্লাস, একাডেমিক কোর্স, বিভিন্ন হটলাইন নম্বর থেকে কল দিয়ে তারা আমাদের একাডেমিক কোর্সগুলো সম্পর্কে জানিয়েছে। আমাদের ভালো ফলে সহায়তা করেছে। এ জন্য প্রথম আলো ও শিখোকে ধন্যবাদ।’
‘স্বপ্ন দেখো, জীবন গড়ো’ স্লোগানে সারা দেশের ৬৪টি জেলায় চলছে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতী সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। আয়োজনটি পাওয়ার্ড বাই বিকাশ এবং সহযোগিতায় থাকছে কনকর্ড গ্রুপ, ফ্রেশ, বহুব্রীহি, সানকুইক, কনকা-গ্রি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ শাখা ক্যাম্পাস, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, এটিএন বাংলা ও প্রথম আলো বন্ধুসভা।
অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য অতিথিদের অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যের পাশাপাশি সংগীত, আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশন করেছে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় শিল্পীরা। সংগীতে ছিলেন আঁখি দে, সুস্মিতা দে, প্রীতি দে, তূর্য্য; কবিতা আবৃত্তি করেন মহিমা রহমান মিম; নৃত্য পরিবেশন করেন শরমিতা পোদ্দার দিশা, জেবা তাছনিম ফারিয়া ও শ্রুতি বণিক। তাঁদের পরিবেশনায় মিলনায়তন মুখর হয় ওঠে।