গুলিবিদ্ধ শিশুটি ব্যথায় কাতরাচ্ছে আর বলছে, ‘বেদনা করতাছে’

সিলেটের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শফিকছবি: প্রথম আলো

গুলিবিদ্ধ ১২ বছরের শিশুসন্তানের শিয়রের পাশে বসে আছেন মা। শিশুটি ব্যথায় বারবার কাতরাচ্ছে আর মাকে বলছে, ‘বেদনা করতাছে।’ মা আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর চোখের পানি ফেলছেন। গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সিলেট নগরের আখালিয়া এলাকায় মাউন্ট এডোরা হসপিটালে গিয়ে এ দৃশ্যের দেখা মেলে।

এর আগে গত শুক্রবার বিকেল পাঁচটার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আখালিয়া এলাকায় পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে শিশুটি গুলিবিদ্ধ হয়। তাৎক্ষণিকভাবে একজন পুলিশ সদস্য শিশুটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।

গুলিবিদ্ধ শিশুর নাম শফিক আলী। তাদের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ইসলামপুর ছনবাড়ি ধনটিলা গ্রামে। স্বামীর সঙ্গে ১২ বছর আগে আরফিনা বেগমের বিচ্ছেদ হয়। শফিককে নিয়ে তার মা আরফিনা সিলেট শহরে চলে যান। এরপর গৃহপরিচারিকার কাজ করে সংসার চালাতে থাকেন তিনি। এখন একমাত্র ছেলেকে নিয়ে সিলেট নগরের বড়গুল টিলারগাঁও এলাকায় এখন ভাইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ভাড়া বাসায় থাকেন আরফিনা।

আরও পড়ুন

হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, শফিক একটি বিছানায় শুয়ে আছে। তার পাশে মা ও দুজন স্বজন। শফিক কখনো ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছে, আবার কখনো কেঁদে কেঁদে ধীরলয়ে এপাশ-ওপাশ হচ্ছে। তার পরনের নেভি ব্লু-সাদা গেঞ্জির সাদা অংশে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে। গেঞ্জির মধ্যে অসংখ্য ফুটো ফুটো ছিদ্র। এগুলো ছররা গুলির চিহ্ন বলে শফিকের মা জানালেন।

আরফিনা বেগম বলেন, তিনি অন্যের বাড়ি কাজ করে দুই হাজার টাকার মতো পান। ছেলে দৈনিক ৫০ টাকা বেতনে নয়াবাজার এলাকার একটা ওয়ার্কশপে কাজ করে। দুজনের আয়ে অভাবের সংসার টেনেটুনে কোনোরকমে চলছে।

শফিকের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর আরফিনা পেয়েছেন পরিচিত একজনের কাছ থেকে। ফেসবুকে শফিকের গুলিবিদ্ধ ছবি দেখেই ওই পরিচিত ব্যক্তি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আরফিনাকে খবর দেন। এরপর তিনি হাসপাতালে ছুটে আসেন। পরে ছেলে ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত জানেন।

আরফিনা বলেন, শফিকের সৎমায়ের সন্তান হয়েছে। তাকে দেখতে শফিক তার বাবার সঙ্গে আলাপ করে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায়। সেখান থেকে অটোরিকশা দিয়ে বাসায় ফিরছিল। মদিনা মার্কেট এলাকায় এসে সে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে। তখন রিকশাচালক তাকে নামিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন

রিকশা থেকে নেমে যাওয়ার পর শফিক হেঁটে বাসার উদ্দেশে রওনা হয় বলে আরফিনা বললেন। তিনি বলেন, ‘পুলাডা আখালিয়া এলাকায় আওয়ামাত্রই পুলিশের গুলি লাগে তার শরীরও। মাটিত পইড়া যায়। একটু উঠতে চাইলে ধুমা-গুলি (কাঁদানে গ্যাসের শেল) লাগে, আবার পইড়া যায়। আমার পুলার শরীলডা ঝাঁঝরা অইয়া গেছে! পরে এক পুলিশ স্যার তারে হাসপাতালও নিয়া আইছইন। পুলিশ স্যাররাই চিকিৎসার সব ট্যাকা এখন দিতাছইন।’

কথা বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন আরফিনা বেগম। তিনি বলেন, ছেলের ডান পাশে অসংখ্য ছররা গুলি লেগেছে। চিকিৎসকেরা কিছু বের করলেও অনেকগুলো এখনো শরীরের ভেতরে রয়ে গেছে। ছেলেটা জীবনে আর সুস্থ হবে কি না, সে আশঙ্কায় আছেন তিনি।

শফিক এখন কেমন আছে, এমন প্রশ্নের জবাবে মাউন্ট এডোরা হসপিটালের ডেপুটি পরিচালক (মেডিকেল সার্ভিসেস) তানভীর উজ জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুটিকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সে এখন আশঙ্কামুক্ত ও অনেকটাই সুস্থ আছে।’ তবে শিশুটির শরীরে কতটি গুলি লেগেছে, তা এখনো গণনা করা সম্ভব হয়নি বলে তিনি জানিয়েছেন।

এদিকে শিশুর মায়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মো. আজবাহার আলী শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুটির শরীরে কার ছোড়া গুলি লেগেছে, সেটা তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। এ ঘটনায় মামলা হবে, তখন পুলিশ তদন্ত করে দেখবে, পুলিশ নাকি অন্য কারও ছোড়া গুলি লেগেছে। এর আগে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।’