২০০৮ সালে শফিকুল ইসলাম যখন প্রথম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করেন, তখন তাঁর স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতীর কোনো আয় ছিল না। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বলতে ছিল নগদ ১ লাখ টাকা, ১০ ভরি সোনা ও ৩ লাখ টাকা দামের অকৃষিজমি। দেড় দশকে একবার উপজেলা চেয়ারম্যান ও দুবার সংসদ সদস্য হয়েছেন শফিকুল ইসলাম। এই ১৫ বছরে শামীমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১৬৫ গুণ। একই সময়ে লাখপতি থেকে কোটিপতি হয়েছেন সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম।
শফিকুল ইসলাম ওরফে শিমুল নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) আসনের টানা দুবারের সংসদ সদস্য এবং সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামা এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ তিনটি নির্বাচনের হলফনামা পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
শফিকুলের আয় বেড়েছে সাড়ে ২৬ গুণ
সংসদ সদস্য শফিকুল এবারের হলফনামায় বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৫৩ লাখ ৩ হাজার ১০৯ টাকা। ২০০৮ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় তাঁর বার্ষিক আয় ছিল ব্যবসা থেকে মাত্র দুই লাখ টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরে তাঁর আয় বেড়েছে সাড়ে ২৬ গুণ। এ সময়ে ব্যবসা খাতের বাইরে এফডিআর মুনাফা, বেতন–ভাতা বাবদ আয় বেড়েছে। তবে ২০১৮ সালের তুলনায় এবার তাঁর আয় কমেছে। সেবার তিনি হলফনামায় ৬৪ লাখ ১৪ হাজার ২৪১ টাকা আয় দেখিয়েছিলেন। আর প্রথমবার সংসদ নির্বাচনের সময় তাঁর আয় ছিল ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৯২০ টাকা।
২০০৮ ও ২০১৩ সালে নির্বাচনের সময় হলফনামায় স্ত্রীর কোনো আয় উল্লেখ করেননি শফিকুল ইসলাম। ওই সময় ব্যবসা কিংবা কোনো খাতে সংসদ সদস্যের স্ত্রী শামীমার কোনো আয় ছিল না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তাঁর বার্ষিক আয় দেখানো হয় ২২ লাখ ৬৮ হাজার ৩২৭ টাকা। পাঁচ বছর পরে এবার আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ লাখ ২৮ হাজার ৩৬০ টাকা। এ সময়ে ব্যবসা থেকে ২৪ লাখ ২৬ হাজার ও সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক মুনাফা বাবদ বাকি আয় দেখিয়েছেন। পাঁচ বছরে তাঁর বার্ষিক আয় ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা বেড়েছে।
লাখপতি থেকে কোটিপতি
১৫ বছর আগে শফিকুল ইসলামের স্থাবর ও অস্থাবর মোট সম্পদ ছিল ১৪ লাখ ৫৪ হাজার ২৬২ টাকার। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তাঁর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৯৫ লাখ ৩১ হাজার ৬৪৬ টাকা। অর্থাৎ দেড় দশকে তাঁর সম্পদ বেড়েছে ৩৪ গুণের বেশি। ২০০৮ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় তাঁর কাছে নগদ প্রায় ৮ লাখ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এর বাইরে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের ২০ ভরি সোনা, ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা দামের একটি মোটরসাইকেল, ৮০ হাজার টাকা মূল্যের কৃষিজমি ছিল।
১৫ বছরের ব্যবধানে এখন তাঁর হাতে নগদ টাকা আছে দেড় কোটি টাকার বেশি। এ সময়ে ব্যাংকে জমা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ লাখের বেশি। ৫ বছর আগে কোনো কোম্পানির শেয়ার না থাকলেও এবার তাঁর কাছে সামির ইমপ্যাক্স লিমিটেডের ৫০ লাখ টাকার শেয়ার আছে। দেড় কোটি টাকার বেশি দামের দুটি গাড়িতে চড়েন তিনি। ১০ বছর আগে স্থায়ী আমানতে কোনো বিনিয়োগ না থাকলেও এখন এ খাতে তাঁর বিনিয়োগ ৬১ লাখ টাকার। ২০১৮ সালে তাঁর মোট সম্পদ ছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ ২৮ হাজার ৯০৮ টাকার। আর ২০১৩ সালে ছিল ৩২ লাখ ৫৭ হাজার ৩৩৮ টাকা। শুধু গত ১০ বছরে তাঁর ১৫ গুণের বেশি সম্পদ বেড়েছে।
স্ত্রী বেশি বিত্তশালী
২০০৮ সালে শফিকুলের স্ত্রী শামীমার স্থাবর সম্পদ বলতে ছিল তিন লাখ টাকা মূল্যের অকৃষিজমি। ১৫ বছরে তাঁর নামে প্রায় ২৮ শতাংশ জমির ওপর ৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা দামের তিনতলা বাড়ি, পৌনে ৮২ লাখ টাকা দামের ২ হাজার ৭২৪ বর্গফুটের ফ্ল্যাট হয়েছে। ৫ বছর আগেও স্থাবর সম্পদ হিসেবে শামীমার নামে শুধু ১৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দামের ১৪ শতাংশ অকৃষিজমি ছিল। অর্থাৎ পাঁচ বছরে শামীমার স্থাবর সম্পদ বেড়েছে ২৭ গুণ।
এবারের হলফনামায় শামীমার নামে ৩ কোটি ১৬ লাখ ৫৪ হাজার ৬৫৬ টাকার অস্থাবর সম্পদ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে হাতে নগদ ১ কোটি ৫৬ লাখ, ৫০ লাখ টাকার শেয়ার, ৬৯ লাখ টাকার এফডিআর আছে। ২০১৮ সালে তাঁর নামে কোনো কোম্পানির শেয়ার ছিল না। এ ছাড়া সাড়ে ৩৪ লাখ টাকা দামের গাড়িতে চড়েন শামীমা। তাঁর কাছে পৌনে ২ লাখ টাকার ৩৫ ভরি সোনা আছে। ২০২৩ সালে এসে স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে শামীমার নামে ৭ কোটি ৫৭ লাখ ৭১ হাজার টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে শফিকুল দেখিয়েছেন ৪ কোটি ৮৬ লাখ ৪৫ হাজার ৪৪৬ টাকার সম্পদ। সেই হিসাবে শফিকুলের চেয়ে এখন তাঁর স্ত্রী শামীমা বেশি বিত্তশালী।
শামীমার সম্পদ বেড়েছে ১৬৫ গুণ
১৫ বছর আগে শামীমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছিল ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকার। ২০১৩ সালে তাঁর সম্পদ বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকায়। তখন শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা হিসেবে ১০ লাখ টাকা বাড়ে। ২০১৮ সালে তাঁর সম্পদ বেড়ে ১ কোটি ৮৫ লাখ ১৭ হাজার ৬৯৯ টাকায় ঠেকে। তখন ৫৮ লাখ টাকা নগদ, ৫৪ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত, সাড়ে ৩৪ লাখ টাকার গাড়ি হয়। একই সময় সোনার পরিমাণ ১৫ থেকে ৩৫ ভরিতে ঠেকে। বর্তমানে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৭ কোটি ৫৭ লাখ ৭১ হাজার ৭০৬ টাকা। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে তাঁর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১৬৫ গুণ।
পেশায় ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় পেশার ঘরে প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার উল্লেখ করেছিলেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাস হলেও সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় আইনে স্নাতক উল্লেখ করেছেন। ২০১৮ সালে তাঁর ৬৬ লাখ টাকার ব্যক্তিগত ও ব্যাংকঋণ থাকলেও এবার তাঁর কোনো দায়দেনা নেই।