রাজবাড়ীতে প্রণোদনার পেঁয়াজের বীজ গজায়নি, বিপাকে চার হাজার কৃষক
রাজবাড়ীর চার হাজার কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে বিনা মূল্যে তিন ধরনের পেঁয়াজের বীজ (দানা) সরবরাহ করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। ১১ থেকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে পাওয়া এসব বীজ কৃষকেরা বপন করলেও জেলার অধিকাংশ জায়গায় চারা গজায়নি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন কৃষকেরা।
ক্ষতিপূরণের দাবিতে গত বুধবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে জেলা কৃষক সমিতি। এর আগে ২ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভায় বিএডিসির এমন কর্মকাণ্ডকে ‘দায়িত্বহীন’ বলে উল্লেখ করা হয়।
এ ঘটনায় জেলা প্রশাসকের নির্দেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজবাড়ীর উপপরিচালককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজবাড়ী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পেঁয়াজ উৎপাদনে সারা দেশে তৃতীয় অবস্থানে রাজবাড়ী। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় ১৪ শতাংশের জোগান দেয় এই জেলা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জেলার পাঁচ উপজেলায় রবি ফসলের প্রণোদনা হিসেবে বিএডিসি থেকে বিনা মূল্যে পেঁয়াজের বীজ বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে ১৩ নভেম্বর সদর উপজেলায় ৮০০ জন, ১১ নভেম্বর পাংশায় ১ হাজার, ১৫ নভেম্বর কালুখালীতে ৮০০ জন, ১৩ নভেম্বর বালিয়াকান্দিতে ১ হাজার এবং ১৪ নভেম্বর গোয়ালন্দ উপজেলায় ৪০০ কৃষককে এক কেজি করে পেঁয়াজবীজ ও ২০ কেজি করে সার দেওয়া হয়। বীজ বাবদ বিএডিসিকে প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয় কৃষি বিভাগকে। জেলার প্রায় ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদনের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় প্রায় ৫ হাজার ৭৯৩ মেট্রিক টন। কিন্তু অঙ্কুরিত না হওয়ায় ৭ থেকে ৮ হাজার হেক্টর জমির পেঁয়াজ আবাদ কম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ ৩২ কোটি ৩৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন। কৃষক ফরিদ মণ্ডল বলেন, সরকারিভাবে পাওয়া বীজ দুই বিঘা জমিতে লাগিয়েছিলেন। একটিও চারা না গজানোয় কিছু করতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি একজন গরিব কৃষক। সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণ দিলে কিছু করতে পারতাম। যে কৃষকই এসব বীজ বপন করেছেন, তিনিই ধরা খেয়েছেন। অথচ গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা বীজ ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ চারা গজায়ছে।’
সরেজমিন ৪ ডিসেম্বর রাজবাড়ীর দুটি উপজেলার কয়েকটি মাঠ ঘুরে দেখা যায়, বিএডিসি থেকে সরবরাহ করা বীজ না গজানোয় কৃষিজমি পতিত পড়ে আছে। অথচ আশপাশের অনেক জমিতে বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি থেকে দেওয়া বীজ থেকে চারা গজিয়েছে।
সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়নের কাঁচরন্দ গ্রামের কৃষক আবদুস সালাম খান বলেন, ২০ দিন আগে উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে বারি-৪ জাতের ১ কেজি পেঁয়াজবীজ ও ২০ কেজি সার দেওয়া হয়। বীজ এনে জমি প্রস্তুত করে বপন করেন। চারা না গজানোয় কয়েকবার সেচ দিয়েছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তিনি বলেন, ‘শুধু আমার নয়, এ রকম বীজ যাঁরা এনেছেন, সবার একই অবস্থা। এখন না পারছি নতুন করে বীজ বপন করতে, না পারছি এই জমিতে কিছু করতে।’
কৃষক সাঈদ মণ্ডল বলেন, ‘বীজ মাটিতে পড়ার ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে চারা গজায়। অথচ এ বীজ ১৪-১৫ দিনেও গজায়নি। আমি এক কেজির সঙ্গে ৪ হাজার টাকা কেজি দরে স্থানীয়ভাবে তিন কৃষকের থেকে কিনে নিই। এত টাকার কেনা বীজের সঙ্গে জমি নষ্ট করলাম। এই বীজ থেকে ৭-৮ বিঘা জমিতে চারা রোপণ করতে পারতাম। এখন নতুন করে ফরিদপুর পর্যন্ত যোগাযোগ করেছি, কিন্তু কোথাও বীজ পাচ্ছি না।’
জানতে চাইলে রাজবাড়ীর দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএডিসির জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক (বীজ বিপণন) নিপুণ কুমার নন্দী বলেন, ৪ হাজার কৃষকের মধ্যে ৫০০ জনকে বারি-১, ১ হাজার কৃষককে বারি-৪ এবং আড়াই হাজার কৃষককে তাহেরপুরি জাতের বীজ দেওয়া হয়। বারি-১ জাতের কোনো অভিযোগ পাননি। তাহেরপুরির প্রায় ৫০ শতাংশ এবং বারি-৪ জাতের বীজ বেশির ভাগ গজায়নি বলে অভিযোগ আছে। তাঁদের দায়িত্ব বীজ আসামাত্র বিতরণ করা। বীজের মান সম্পর্কে তাঁদের ধারণা নেই। যেভাবে অভিযোগ করা হচ্ছে, ক্ষতির পরিমাণ এমন নয়। বিএডিসির ঢাকা থেকে পৃথক তদন্ত কমিটি এলাকায় কাজ করছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে চার হাজার কৃষকের মধ্যে ৩ হাজার ৭২৫ জনের মতো ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। ক্ষয়ক্ষতির যে চিত্র পাওয়া গেছে, মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে গত বুধবার কৃষি উপদেষ্টা, বিএডিসির চেয়ারম্যানসহ উচ্চপর্যায়ের সভা হয়। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দ্রুত বীজ দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়।