ঈদের ছুটিতে ঝালকাঠির রাজাপুরে বাবার বাড়ি এসেছিলেন দুই বোন। বড় বোনের সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্বামী ও দুই ছেলে–মেয়ে। এক মাস আগে বিয়ে হওয়া ছোট বোন এসেছিলেন স্বামীকে নিয়ে। ছুটি শেষে গতকাল বুধবার দুই বোনের পরিবারের সবাই মিলে প্রাইভেট কারে করে বরিশালে যাচ্ছিলেন।
পথে বেলা দুইটার দিকে গাবখান সেতুর টোল প্লাজায় সিমেন্টবোঝাই একটি ট্রাক তাদের প্রাইভেট কারের ওপর উঠে যায়। এতে দুই বোনের পরিবারের ছয়জন ও চালক নিহত হন।
নিহত সাতজন হলেন রাজাপুর উপজেলার উত্তর সাউথপুর এলাকার মো. হাসিবুর রহমান (৩৫), তাঁর স্ত্রী নাহিদা আক্তার (৩০), তাদের মেয়ে চার বছরের তাকিয়া ও ছেলে এক বছর বয়সী তাহমিদ, নাহিদার ছোট বোন রিপা আক্তার (২২) ও তাঁর স্বামী পিরোজপুরের আল-ইমরান (২৩) এবং প্রাইভেট কারের চালক রাজাপুরের উত্তর উত্তমপুর গ্রামের ইব্রাহিম (৩৫)।
আজ বৃহস্পতিবার দুই বোনের পরিবারের পাঁচজনের ও চালকের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। বিমানবাহিনীতে কর্মরত আল–ইমরানের মরদেহ ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। ওই দুর্ঘটনায় প্রাইভেট কারের আরোহী, ইজিবাইকের আরোহী, পথচারীসহ মোট ১৪ জন নিহত হন।
কান্না থামছে না বাবার
দুই মেয়ে, দুই জামাতা ও নাতি–নাতনিকে হারিয়ে কান্না থামছে না রাজাপুরের সাঙ্গর গ্রামের বারেক মৃধার। তিনি আজ বৃহস্পতিবার জানান, ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছিল দুই মেয়ের পরিবার। বড় মেয়ে নাহিদা স্বামীর সঙ্গে সিলেটে থাকতেন। জামাতা হাসিবুর একটি কুরিয়ার সার্ভিসে ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করতেন। সম্প্রতি তিনি সিলেট থেকে বরিশালে বদলি হন। তাঁদের জন্য বাসা দেখতে সবাই মিলে প্রাইভেট কারে বরিশালে যাচ্ছিলেন। পথে দুর্ঘটনা ঘটে। কাঁদতে কাঁদতে বারেক মৃধা বলেন, ‘একবার মনে হলো, নাতি–নাতনিকে যেতে দেব না। তারপর কী মনে করে যেতে দিলাম!’
আজ দুপুরে উত্তর সাউথপুর গ্রামে হাসিবুর রহমান, তাঁর স্ত্রী নাহিদা আক্তার, দুই সন্তান তাকিয়া ও তাহমিদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এক সঙ্গে পরিবারের চারজনের দাফনে এসে স্বজন ও প্রতিবেশীরা শোকাহত ছিলেন।
মেহেদির রং মোছেনি
নিহত রিপা আক্তারের বোন তরিকা আক্তার বলেন, ‘রিপার এক মাস আগে বিয়ে হয়েছে। ওদের হাতের মেহেদির রং এখনো মোছেনি। বোন–দুলাভাইয়ের ইচ্ছা ছিল বরিশাল থেকে কুয়াকাটায় হানিমুনে যাবে। সেই ইচ্ছা আর পূরণ হলো না।’
আরেক বোন মনি আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘এক বোনের পরিবার বরিশালে যাবে, আরেক বোনের পরিবার কুয়াকাটায় যাবে। কারও কোথাও যাওয়া হলো না। দুপুরে সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে রাস্তায় নেমে দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেল।’
রিপা আক্তারকে আজ বাবার বাড়ি রাজাপুরের সাঙ্গর গ্রামে দাফন করা হয়েছে।
চালকের পরিবারে আহাজারি
প্রাইভেটকারের চালক ইব্রাহিমকে আজ সকালে তাঁর উত্তর উত্তমপুর গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। ইব্রাহিমের বৃদ্ধ মা সেতারা বেগম আহাজারি করে বলেন, ‘আমার একমাত্র ছাওয়াল ইব্রাহিমের আশা আর পূরণ হইল না। কী হইবে ওর দুইডা পোলার। কেমনে চলমু মোরা। ও আল্লাহ এয়া কী করলা। আমারে ক্যা এমন শাস্তি দিলা।’
সহায়তার ঘোষণা
আজ সকালে ঝালকাঠি-২ আসনের সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমু দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, সড়কে চার লেনের কাজ সম্পন্ন হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।
দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। এ ছাড়া যারা পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে তিন লাখ টাকা এবং আহত ব্যক্তিদের জন্য এক লাখ টাকা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে। এ ছাড়া তদন্তের জন্য চার সদস্যের কমিটি করা হয়েছে।
ট্রাকের চালক ও সহকারী কারাগারে
আটক ট্রাকের চালক আল আমিন (৩২) ও তাঁর সহকারী নাজমুলের (২২) বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ঝালকাঠি থানায় মামলাটি করেন দুর্ঘটনায় একই পরিবারে নিহত ছয়জনের স্বজন মো. হাদিউর রহমান (২৩)। তিনি নিহত হাসিবুর রহমানের ছোট ভাই।
ঝালকাঠি সদর থানার ওসি মো. শহিদুল ইসলাম জানান, ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনে মামলাটি করা হয়েছে। মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁদের আদালতে পাঠানো হয়েছে।
আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান জানান, ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. মনিরুজ্জামান ওই দুজনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। গতকাল বুধবার ১৪ জন নিহতের ঘটনার তিন ঘণ্টার মধ্যে শহরের বাসন্ডা গ্রাম থেকে তাঁদের আটক করে ডিবি পুলিশ। ঝালকাঠি ডিবির পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান জানান, চালক আল আমিনের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। তিনি হালকা যানের লাইসেন্স দিয়ে ভারী যানবাহন চালাচ্ছিলেন।