সিলগালা করা ২৮ করাতকলে আবার চলছে কাঠ চেরাই 

গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে অভিযান চালিয়ে এই করাতকলগুলো সিলগালা করেছিল উপজেলা প্রশাসন।

কক্সবাজারের পেকুয়া বাজার এলাকায় একটি করাতকলে চেরাইয়ের জন্য রাখা গাছ। গত সোমবার বেলা তিনটায়ছবি: প্রথম আলো

আট মাস আগে সিলগালা করা কক্সবাজারের পেকুয়ার ২৮টি করাতকলে আবারও শুরু হয়েছে কাঠ চেরাই। গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে পৃথক অভিযান চালিয়ে লাইসেন্স না থাকায় এবং বনের কাঠ চেরাইয়ের অভিযোগে করাতকলগুলো সিলগালা করেছিল উপজেলা প্রশাসন। তবে এখন কীভাবে এই অবৈধ করাতকলগুলো আবার চালু হয়েছে, সে উত্তর মেলেনি প্রশাসনের কাছে।

তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলামের নির্দেশে পেকুয়ার ২৮টি অবৈধ করাতকলে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন সাবেক উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুম্পা ঘোষ এবং বর্তমান সহকারী কমিশনার নূর পেয়ারা বেগম। তখন জব্দ করে প্রতিটিতে ‘অবৈধ করাতকল পরিচালনা করায়, উক্ত করাতকলটি সিলগালা করা হলো। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত করাতকলটি বন্ধ থাকিবে’ লেখা কাগজের নোটিশ সাঁটানো হয়। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বদলির সুযোগ নিয়ে প্রভাবশালী মালিকেরা অবৈধ করাতকলগুলো আবার চালু করেছেন বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

৩০ ডিসেম্বর বেলা তিনটার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, পেকুয়া বাজারের গাছের দোকান এলাকায় ১০টি, বাজারের পশ্চিমে ৩টি, চড়াপাড়া বাজার এলাকায় ৩টি, বারবাকিয়া ইউনিয়নের ফাঁসিয়াখালী সেতুর পাশে ২টি, বারবাকিয়া বাজারে ৩টি, মৌলভীবাজারে ২টি, টৈটং বাজারে ১টি, হাজী বাজারে ২টি, টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের পাশে ২টি, রাজাখালী আরবশাহ বাজারে ৩টি এবং দশেরঘোনা এলাকায় ১টি করাতকলে বনের কাঠ চেরাই চলছে। এসবের মধ্যে ২৮টি করাতকল বন্ধ করেছিল উপজেলা প্রশাসন।

আরবশাহ বাজারের একটি করাতকলের মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘করাতকল জব্দের পর থেকে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো সুরাহা পাইনি। তাই নিজেরা প্রশাসন কর্তৃক সাঁটানো কাগজ সরিয়ে করাতকল চালু করেছি।’

পেকুয়া কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফরিদুল আলম দাবি করেছেন, অনেক চেষ্টা করেও করাতকলের লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁরা করাতকলের মালিক, তাঁরা সবাই গরিব মানুষ। প্রশাসন করাতকল জব্দ করলেও পেটের দায়ে তাঁরা নিজেদের মতো করে চালু করে নিয়েছেন।

করাতকল বিধিমালা ২০১২ অনুযায়ী, সংরক্ষিত, রক্ষিত ও সরকারি—যেকোনো ধরনের বনভূমির সীমানা থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপন করা যাবে না। পেকুয়ার সব করাতকল বনের ১০ কিলোমিটারের ভেতরে অবস্থিত। এ কারণে বন বিভাগ করাতকলগুলোর লাইসেন্স দিচ্ছে না বলে জানা যায়।

চকরিয়ার হারবাং ও ফাঁসিয়াখালীর সংরক্ষিত বন এবং লামার আজিজনগরের সংরক্ষিত বন থেকে মা গাছসহ (গর্জন) বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে ট্রাকে বোঝাই করে পেকুয়ার করাতকলগুলোতে পাচার করছে কাঠ পাচারকারী চক্র। বরইতলী-মগনামা সড়ক দিয়ে প্রতি রাতে অবাধে বনের গাছ পাচার করা হলেও পুলিশকে কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। অন্যান্য সময় চুরি করে রাতের আঁধারে গাছ পাচার করলেও বর্তমানে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় মা গাছ পাচার করা হচ্ছে। গাছ চেরাইয়ের পর কাঠ দিয়ে তৈরি হচ্ছে মাছ ধরার বড় বড় ট্রলার। বন বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন বলছে, বন থেকে গাছ কাটা, কাঠ পাচার করা, কাঠ চেরাই করা, ট্রলার তৈরি করা—এই চার কাজই চলছে অবৈধভাবে।

পেকুয়া থানার ওসি মোহাম্মদ সিরাজুল মোস্তফা বলেন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পাচারকারীরা সংরক্ষিত বনের মা গাছ পাচার করেছে। বিষয়টি এখন নজরে এসেছে। 

স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা বলেন, ৩০ বছর আগেও পেকুয়ায় মাত্র দু-একটি করাতকল ছিল। তখন পেকুয়ার সংরক্ষিত বনাঞ্চল গাছে ভরপুর ছিল। করাতকল বাড়ার সঙ্গে কমতে থাকে বন। এখন বারবাকিয়া বনাঞ্চলে গাছ কমে যাওয়ায় পাচারকারী চক্র চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী, হারবাং, লামার ফাইতং, আজিজনগর এবং চট্টগ্রামের লোহাগাড়া বনাঞ্চল থেকে মা গাছসহ (গর্জন) অন্যান্য গাছ কেটে পাচার করছে। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, করাতকল স্থাপনের অন্যতম দুই শর্ত হচ্ছে বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্র। কিন্তু পেকুয়ার একটি করাতকলেরও সেই অনাপত্তিপত্র নেই। 

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক বলেন, পেকুয়ার করাতকলগুলোতে বনের গাছ চেরাই হচ্ছে সত্য। এসব করাতকলের একটিরও বৈধ কাগজপত্র নেই। বন বিভাগ অনেকবার অভিযান চালিয়েছে। কিছু করাতকলের গাছ চেরাইয়ের সরঞ্জামাদি জব্দ করে রেঞ্জ অফিসে নিয়ে আসা হয়েছিল। উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে আবারও অভিযান চালানো হবে।

পেকুয়ার ইউএনও মোহাম্মদ মঈনুল হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক অবৈধ ২৮টি করাতকল জব্দের বিষয়টি আমার নজরে রয়েছে। তবে গত ৫ আগস্টের নানা গোলযোগের সুযোগে করাতকলের মালিকেরা সেসব আবার চালু করেছেন। অবশ্যই খোঁজ নিয়ে অবৈধ করাতকলের বিরুদ্ধে আবারও অভিযান চালানো হবে।