খুলনায় কৃষকদের ভ্রাম্যমাণ ‘নিরাপদ কৃষি বাজার’
পিকআপ ভ্যানের এক পাশের ডালা খুলে রাখা। সেখানে ঝুড়িতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সবজি। আছে দেশি হাঁস-মুরগির ডিমসহ বিভিন্ন ধরনের ফলও। গ্রামের কৃষকদের পরম যত্নে আবাদ করা এসব পণ্য স্বল্পমূল্যে শহরের মানুষের কাছে বিক্রির আয়োজন করেছেন কৃষকেরাই। নাম দিয়েছেন ‘নিরাপদ কৃষি বাজার’।
৩ অক্টোবর বিকেলে নগরের শিববাড়ী মোড়ে গিয়ে দেখা মেলে ওই বাজারের। বাজারে রয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ ধরনের ফল ও সবজি। যেসব কৃষক পণ্য দিয়েছেন, তাঁদের কয়েকজন ছিলেন ট্রাকের আশপাশে। পণ্য বিক্রিতেও সহযোগিতা করতে দেখা গেছে তাঁদের। ওই কৃষকেরা জানান, প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত খুলনা নগরের শিববাড়ী মোড়ে পিকআপে করে এভাবে পণ্য বিক্রি করা হয়। মাত্র দুই দিন বাজারটি বসেছে; কিন্তু এরই মধ্যে তা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে খুলনা শহরে। খুব বেশি প্রচার না থাকলেও মানুষ এসে পছন্দমতো পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে শিববাড়ী মোড়ে ভ্রাম্যমাণ এই নিরাপদ কৃষি বাজারের কার্যক্রম শুরু হয়। বটিয়াঘাটা উপজেলার কৃষকদের পণ্য একত্র করে ‘মৈত্রী কৃষক ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠন ওই ভ্রাম্যমাণ বাজারে সবজি বিক্রি করছে। কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী না থাকায় অপেক্ষাকৃত কম দাম এসব পণ্যের।
বটিয়াঘাটার কাতিয়ানাংলা গ্রামের কৃষক দীপঙ্কর মণ্ডল বলেন, এই বাজারে সব ধরনের পণ্য নিয়ে আসা হচ্ছে। মাত্র দুই দিন বাজার বসেছে; কিন্তু এরই মধ্যে সাড়া পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে বেশি করে পণ্য নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন তাঁরা।
সেখানে সবজি কিনছিলেন খালিশপুর এলাকার মো. মিলন। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিন শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে পিকআপে সবজি বিক্রি করতে দেখে সেখান থেকে কিছু সবজি কিনেছিলাম। সবজিগুলো বেশ ভালো, তাজা তাজা ভাব আছে। স্বাদেও তারতম্য আছে। দামও তুলনামূলক কম। এ কারণে আজ আবার সবজি কিনতে এসেছি। মান ধরে রাখতে পারলে দিন দিন চাহিদা বাড়বে।’
মৈত্রী কৃষক ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক বিভাষ মণ্ডল বলেন, এখানে যেসব পণ্য বিক্রি হয়, তার সবকিছুই বিষমুক্ত জৈবপদ্ধতিতে উৎপাদিত। কৃষকেরা নিজের বাড়ির ছোট ছোট জায়গায় এসব পণ্য উৎপাদন করেন। নিজেদের বাড়ির চাহিদা মিটিয়ে তা বিক্রি করার জন্যই কৃষকেরা দিয়েছেন। কেউ দিয়েছেন দুই কেজি ঢ্যাঁড়স, আবার কেউ ৫ কেজি পুঁইশাক। কলার মোচা, ঝিঙে, ধুন্দুল থেকে শুরু করে এখানে বিক্রি হওয়া সব সবজি ও ফল এভাবেই সংগ্রহ করা। যিনি যেভাবে পণ্য দেন, তা খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। বিক্রি শেষে কৃষককে দাম অনুযায়ী তাঁর ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
বিভাষ মণ্ডল বলেন, প্রথম দিন প্রায় ৩০ ধরনের পণ্য আনা হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল ৩৫০ কেজির মতো বিভিন্ন ধরনের সবজি। পাশাপাশি ছিল দেশি হাঁস–মুরগির ডিম, বাতাবিলেবু, আমড়াসহ বিভিন্ন ধরনের দেশীয় ফল। রাত ৯টার মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যায়। পরের বৃহস্পতিবার অনেক বৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণে সেদিন সবজি নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। বড় কোনো সমস্যা না থাকলে এখন থেকে নিয়মিত প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে সবজি বিক্রি করা হবে।
দামের পার্থক্য তুলে ধরে মৈত্রী কৃষক ফাউন্ডেশনের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল বলেন, ৩০টি কৃষক সংগঠন এই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত। সদস্যরা নিরাপদ সবজি উৎপাদন করেন, তবে উৎপাদন হিসেবে দাম পান না। বাড়িতে কৃষকেরা ৩৫ টাকা কেজিতে পাইকারি দরে উচ্ছে বিক্রি করেন অথচ বাজার পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকায়। তাঁদের বাজারে উচ্ছে বিক্রি করছেন ৫০-৬০ টাকায়। এই লাভের টাকা কৃষকেরাই পাচ্ছেন। জৈবপদ্ধতিতে উৎপাদিত হওয়ায় এই সবজির স্বাদও আলাদা। ভোক্তা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনতে পারছেন। সার্বিক দিক বিবেচনা করে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাঁদের এই উদ্যোগে সার্বিক সহায়তা করছে ‘লোকজ’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা।
নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও কৃষকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কাজ করে বটিয়াঘাটার বেসরকারি সংস্থা লোকজ। ওই সংস্থার নির্বাহী পরিচালক দেবপ্রসাদ সরকারও ছিলেন ট্রাকের পাশে। তিনি বলেন, মূলত মধ্যস্বত্বভোগীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন ও নিজেরা ব্যাপক লাভ করেন। এই বাজারে মধ্যস্বত্বভোগী রাখা হয়নি। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবই করছে মৈত্রী কৃষক ফাউন্ডেশন; লোকজের পক্ষ থেকে পণ্যগুলো শহরে নিয়ে আসার জন্য শুধু ট্রাকের সুবিধা দেওয়া হয়েছে।