সাদা রঙের জাল দিয়ে ঘেরাও ছোট্ট একটি ঘর। ভেতরে ওড়াউড়ি করছে নানা রঙের প্রজাপতি। কোনোটি আবার বসে পড়েছে হলুদ ফুল কিংবা সবুজ গাছের ওপর। এদের আবার বাহারি সব নাম—মিঞ্জি, বিন্তি, চিতা, কেশবতী আরও কত কি! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজাপতি দেখতে ঘরটির পাশে ভিড় জমিয়েছে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষ। শিশুদের কেউ কেউ ছুঁয়ে দেখতে চায় প্রজাপতির রঙিন ডানা। আবার কেউ অভিভাবকদের কাছে বলছিল ডানা না থাকার আফসোসের কথা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তন এলাকায় আজ শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে ১৪তম প্রজাপতি মেলা। এ উপলক্ষে সেখানে দর্শনার্থীদের আনাগোনা। অভিভাবকদের হাত ধরে এসেছে শিশু-কিশোরেরা। তাদের হাতে শোভা পাচ্ছে নানা রঙের ফেস্টুন। কেউ কেউ পরেছে মুখোশ। কারও গালে হাসছে হাতে আঁকা প্রজাপতির রঙিন প্রতিচ্ছবি। আর তরুণ-তরুণীরা এসেছেন পাঞ্জাবি–শাড়ি পরে। বাদ যাননি প্রবীণেরাও, প্রজাপতির মতোই সাজিয়েছেন তাঁদেরও।
স্কুলশিক্ষক মা রেবেকা আক্তারের সঙ্গে মেলায় এসেছে তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া শিশু নুসাইবা কারিম। সে-ই জানাল, এবার দ্বিতীয়বারের মতো প্রজাপতি মেলায় অংশ নিয়েছে। প্রজাপতির রঙিন পাখা দেখে তারও প্রাণীটির মতো ওড়ার ইচ্ছা জেগেছে। মায়ের কাছে এমন আবদারের কথাই বলছিল সে।
গালে প্রজাপতির প্রতিচ্ছবি এঁকে মেলায় এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আবিদা আক্তার তিশা। ভর্তির পর প্রথমবারের মতো প্রজাপতি মেলায় অংশ নিচ্ছেন তিনি। শিশুদের মতোই প্রজাপতি দেখে ভীষণ আনন্দিত তিনি। আবিদা বলেন, ‘বাচ্চাদের মতো আমারও প্রজাপতি দেখতে ভীষণ ভালো লাগে। মেলায় এসে মন অনেক ভালো হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের প্রজাপতি দেখছি আর সঙ্গে আছে অনেক বাচ্চা।’
‘উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি’ স্লোগানে ২০১০ সাল থেকে প্রজাপতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এ মেলার আয়োজন করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। এবারের ১৪তম প্রজাপতি মেলার উদ্বোধন করেন উপাচার্য মোহাম্মদ কামরুল আহসান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘প্রজাপতিসহ অন্য প্রাণীর প্রতি মানুষের নৈতিক দায়বদ্ধতা আছে। আমি এই আয়োজনকে গুরুত্ব দিই প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, এ আয়োজনের মাধ্যমে প্রাণীর প্রতি নৈতিক বিবেচনা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, একটি অনন্য বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই প্রজাপতি মেলা জাহাঙ্গীরনগরকে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে।’
আজ দিনব্যাপী চলবে প্রজাপতি মেলা। এর মধ্যে আছে শিশু-কিশোরদের জন্য প্রজাপতিবিষয়ক ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা, প্রজাপতি ও প্রকৃতিবিষয়ক কুইজ প্রতিযোগিতা, প্রজাপতির আলোকচিত্র প্রদর্শনী, প্রজাপতিবিষয়ক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা, প্রজাপতির আদলে ঘুড়ি উড্ডয়ন, প্রজাপতি চেনা প্রতিযোগিতাসহ নানা আয়োজন। এ ছাড়া মেলা উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র্যালি ও প্রজাপতির গল্পে পাপেট শো প্রদর্শিত হয়েছে।
প্রজাপতি সংরক্ষণে অবদানের জন্য বন ও প্রকৃতিবিষয়ক সংগঠন ‘প্ল্যান্টেশন ফর নেচারের’ প্রতিষ্ঠাতা সবুজ চাকমাকে এবার ‘বাটারফ্লাই অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়। এ ছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সাব্বির আহমেদ পেয়েছেন ‘বাটারফ্লাই ইয়ং ইনথুসিয়াস্ট অ্যাওয়ার্ড’।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজাপতি কমেছে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালে প্রায় ১১০ প্রজাতির প্রজাপতির দেখা মিলত। ১৪ বছরের ব্যবধানে সেই সংখ্যা কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৭২–এ। এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশদূষণ ও প্রজাপতির বাসস্থান ধ্বংসের প্রভাব বলে মনে করছেন প্রাণী গবেষকেরা। তাঁদের মতে, প্রজাপতি সংরক্ষণে পর্যাপ্ত সুরক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে বাকি প্রজাতিগুলোও বিলুপ্ত হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ ২০২৪ সালের এ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ৭২ প্রজাতির প্রজাপতি দেখা গেছে। প্রজাপতি মেলার আহ্বায়ক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ছোট ছোট উদ্ভিদই মূলত প্রজাপতির বাসস্থান ও খাবারের মূল উৎস। কিন্তু বর্তমানে ক্যাম্পাসে ছোট আকৃতির গাছপালা ও ঝোপঝাড় তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। ফলে প্রজাপতি খাবার ও বাসস্থান সংকটে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমরা গবেষণার জন্য কিছু জায়গা সংরক্ষিত রেখেছি। মূলত সেখানেই প্রজাপতি অবাধে বিচরণ করতে পারে।’
প্রজাপতি সংরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুরক্ষিত ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন প্রজাপতি গবেষক অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন। তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃতিতে প্রজাপতি থাকলে পরাগায়ন হবে, গাছপালা বৃদ্ধি পাবে। জলবায়ু পরিবর্তনে যে প্রভাবগুলো আছে, সেগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম হব।’