সেই কৃষ্টপুর গ্রাম এখন যেমন

ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ি কৃষ্টপুর দেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম। কিন্তু পাঁচ দশকেও এ গ্রামের আলোয় আলোকিত হতে পারেনি জেলার মানুষ।

ঠাকুরগাঁও জেলার মানচিত্র

গ্রামের নাম কচুবাড়ি কৃষ্টপুর। মেঠোপথের ধারে চা–দোকান। সেখানে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে চলছে নানা গল্প। সাম্প্রতিক দিনকাল নিয়েই সে গল্প। আশরাফ আলী বলেন, এশিয়া কাপে বাংলাদেশ হেরে যাওয়ার পর খেলা দেখার মজাটাই শেষ হয়ে গেছে।

হাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ ভালো খেললে গর্বে আমাদের বুকটা ভরে যায়।’ তাঁর কথায় সায় দিয়ে আবদুর রশিদ ও সনাতন রায় মাথা নাড়লেন। শুনতে শুনতে তাঁদের গল্পের সঙ্গে যুক্ত হই।

কচুবাড়ি কৃষ্টপুরের ছেলেমেয়েরা গ্রামে যে আলো জ্বালিয়েছিল, তা গোটা জেলায় ছড়িয়ে দেওয়া খুব কষ্টকর ছিল না। কিন্তু আমরা উদ্যোগ নিতে পারিনি।
মনোতোষ কুমার দে সভাপতি, সুজন, ঠাকুরগাঁও

প্রশ্ন করি, এই গ্রামের কোন কৃতিত্ব নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি? কথাটি শুনে সবার মধ্যেই নীরবতা নেমে এল। চা ফেলে একেকজন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে লাগলেন। শেষমেশ ব্যর্থ হয়ে সনাতন রায় বললেন, ‘হামরা পারিমোনি, তোমরাই কহেন।’

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশকে এগিয়ে নিতে শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে—সরকারের এমন উদ্যোগের পর কচুবাড়ি কৃষ্টপুর দেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু সে অর্জনের পাঁচ দশকেও প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রামের আলোতে আলোকিত হতে পারেনি জেলার মানুষ।

দেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম গঠনের ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্থানীয় তরুণ মোকছেদ আলী। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আবদুল খালেক, আকলিমা বেগম, রিয়াজুল ইসলাম, লুৎফর রহমান, তৈয়বা খাতুন, হাফিজুর রহমান, আবদুল জব্বার, হাসিবুল হকসহ আরও কয়েকজন। গতকাল বুধবার আবদুল খালেকের (৭২) সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়।

আরও পড়ুন

যেভাবে নিরক্ষরমুক্ত হয় গ্রামটি

আবদুল খালেক জানান, আন্দোলনের শুরুতেই তাঁরা গ্রামে মিছিল করে জানান দেন ‘টিপ সই ছি ছি, শিখো নাম লিখিতে।’ পরে ফসলের খেতে পুরুষদের ও চুলার পাশে বসে নারীদের নাম লেখা শেখানোর পাশাপাশি শেখানো হয় অ, আ...ক, খ।

গ্রামের ছেলেমেয়েরা শহরের বিভিন্ন কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের গিয়ে বলেন, তাঁদের গ্রামের কেউ টিপ সই দিতে চাইলে, তাঁর কাছ থেকে যেন ‘নাক সই’ (নাকখত) নেওয়া হয়। পরে নাক সইয়ের অপমান থেকে বাঁচার জন্য বয়স্ক ব্যক্তিরা গ্রামের শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে বলেন, ‘বাবারে, নাম লেখা শিখায়ে দে।’ তিন মাসের পরিশ্রমে গ্রামটি নিরক্ষরমুক্ত হয়ে ওঠে।

অর্জন ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি

১৯৯২ সালের নভেম্বরে ব্র্যাক প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত উন্নয়ন জিজ্ঞাসা গ্রন্থে অর্থনীতিবিদ মো. আনিসুর রহমান উল্লেখ করেন, কচুবাড়ি কৃষ্টপুর গ্রামের কৃতিত্বকে সম্মান জানাতে ১৯৭৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও শহরে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ খবরে অন্য গ্রামের যুবকেরাও নিরক্ষরতা থেকে মুক্তির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। দুই মাসের আন্দোলনে আরও কয়েকটি গ্রাম থেকে টিপ সই দূর হয়ে যায়।

নিরক্ষরতা মুক্তির আন্দোলন চলাকালে কচুবাড়ি কৃষ্টপুর গ্রামে বউ হয়ে আসেন আকলিমা বেগম। এসেই জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনে। আকলিমা বলেন, ‘আমাদের এই কৃতিত্বকে সম্মান জানাতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঠাকুরগাঁওয়ে আসবেন শুনে গ্রামের মানুষ ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। কিন্তু অতিথিরা ঠাকুরগাঁওয়ে এলেও নিরাপত্তার অজুহাতে আমাদের গ্রামে যাননি। তবে রাষ্ট্রপতি মোকছেদ আলীকে একটি ফাউন্টেইন পেন উপহার দিয়ে যান। এরপরই আর কেউ এই অর্জনকে এগিয়ে নিতে পদক্ষেপ নেননি।’

আবদুল খালেক বলেন, ‘নিরক্ষরতা মুক্তির আন্দোলন সারা জেলায় ছড়িয়ে পড়বে, এই স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম থেকে নিরক্ষরতা দূর করেছিলাম। কিন্তু যাঁরা এ কাজ করেছেন, তাঁদের সেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। প্রশাসনও অর্জনটুকু ছড়িয়ে দিতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’ তিনি জানান, মোকছেদ দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যান। মোকছেদের দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছেলে আল আমিন সংসারের চাকা সচল রাখতে অন্য জায়গায় চলে গেছেন।

আবদুল খালেকের সূত্র ধরে মোকছেদ আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মোকছেদের স্ত্রী জাহেদা খাতুন (৬৭) ঘরের বারান্দায় একটি ছাগল নিয়ে বসে আছেন। এই প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে ছুটে এলেন দুই তরুণী। তাঁদের একজন রাবেয়া মল্লিকা। রাবেয়া মোকছেদ আলীর ছোট ভাইয়ের মেয়ে।

রাবেয়া বলেন, ‘সেপ্টেম্বর মাস এলেই কত মানুষ আমাদের এখানে এসে খোঁজখবর নেয়। কিন্তু এর পর আর তাদের দেখা পাওয়া যায় না।’ জাহেদা খাতুন জানান, ২০০৭ সালে তাঁর স্বামী মোকছেদ আলী মারা যান। আর্থিক অনটনে ছেলের

লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এখন ছেলে গরুর খামারে চাকরি করেন।

মোকছেদ আলীর ছেলে মো. আল আমিন মুঠোফোনে বলেন, ‘কচুবাড়ি কৃষ্টপুর গ্রামকে নিরক্ষরমুক্ত করার পর ১৯৭৩ সালে বাবা রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছিলেন। সেই স্মৃতি গর্বের হলেও, এখন তা যন্ত্রণার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভাবের কারণে বাবার দেখানো সেই পথে হাঁটতেও পারিনি।’

জেলায় সাক্ষরতার হারের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ইনেফেপ, বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্প, গ্রাম মিলন কেন্দ্র, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্প-১, ২ ও পিএলসিইএইচডি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ২০০০ সালে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন (টিএলএম) কর্মসূচির মাধ্যমে ৩ লাখ ৭ হাজার ৮০০ নারী-পুরুষকে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে গড়ে তোলা হয়। টিএলএম কর্মসূচি বাস্তবায়ন শেষে প্রশাসন সে সময় জেলার সাক্ষরতার হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তেমন একটা বাড়েনি। এখন জেলায় মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প চলছে।

বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নে দেওয়া একনজরে ঠাকুরগাঁওয়ের তথ্য থেকে দেখা যায়, বর্তমানে জেলায় সাক্ষরতার হার ৫২ শতাংশ।

এ মুহূর্তে জেলার সাক্ষরতার হার কত, তা নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আলী নেওয়াজ। তিনি বলেন, জেলার সাক্ষরতার হার ৫৫ থেকে ৬০–এর মধ্যে। তবে তথ্য বাতায়নে জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো পেজে জেলার সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৩ দেখানো হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ঠাকুরগাঁওয়ের সভাপতি মনোতোষ কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিরক্ষরমুক্ত করে কচুবাড়ি কৃষ্টপুরের ছেলেমেয়েরা গ্রামে যে আলো জ্বালিয়েছিল, তা গোটা জেলায় ছড়িয়ে দেওয়া খুব কষ্টকর ছিল না। কিন্তু আমরা সে উদ্যোগ নিতে পারিনি।’

অধ্যাপক মনোতোষ কুমার দে আরও বলেন, শুধু প্রকল্প হাতে নিয়ে নয়, এ ধরনের কাজ ছড়িয়ে দিতে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। মোকছেদ আলীর মতো যুবকদের খুঁজে বের করে তাঁদের কাজে নামাতে হবে।