ফরিদপুরে সমাবেশস্থল পরিপূর্ণ, আশপাশের বাড়ির উঠানে বিএনপির কর্মীরা
বিএনপির আগের বিভাগীয় গণসমাবেশগুলোয় দু-তিন দিন আগে থেকেই শত শত নেতা–কর্মী সমাবেশস্থলে জড়ো হন। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে বাড়ি থেকে চিড়া-মুড়ি নিয়ে এসে সমাবেশের মাঠেই ঘুমাতে দেখা যায় তাঁদের। এবার ফরিদপুরের গণসমাবেশ ঘিরে অনেকটা একই চিত্র দেখা গেছে। চাদর, কাঁথা, বিছানা নিয়ে আগেই এসেছেন অনেক নেতা–কর্মী। অনেকে স্থানীয় লোকজনের বাড়ির উঠানে, বারান্দায় রাত কাটাচ্ছেন।
এখানে এসে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, পরিচয় হয়েছে। সবার সঙ্গে বেশ আনন্দেই আছি। তবে মনে ভয়, বাড়ি গেলে তো ভাঙচুর হতে পারে।কাশেম শেখ, রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার জয়গ্রাম থেকে আসা বিএনপি কর্মী
ফরিদপুর শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে কোমরপুর আবদুল আজিজ ইনস্টিটিউশন মাঠে আজ শনিবার বেলা ১১টায় শুরু হবে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। সেই মাঠের পেছনে রাহেলা বেগমের বাড়ি। তাঁর বাড়ির উঠানে শুয়ে ছিলেন এরশাদ হোসেন মনিসহ কয়েকজন। এরশাদ হোসেন এসেছেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতী থেকে। সেখানে ইলেকট্রনিক পণ্যের ছোট একটি ব্যবসা রয়েছে তাঁর।
রাতে গণসমাবেশের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মঞ্চে কিছুক্ষণ স্লোগান, কিছু সময় বক্তৃতা আবার সময়–সময় গানবাজনা চলছে। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর ও বরিশালের গণসমাবেশের যে মেজাজ ছিল, তা ফরিদপুরে এসে অনেকটা উৎসবে রূপ নিয়েছে। মাঠের চারপাশ পাঁচ জেলার নেতাদের ছোট-বড় ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। নানা রঙের টুপি, টি–শার্ট গায়ে কর্মী-সমর্থকেরা সেখানে এসেছেন।
এরশাদ হোসেন জানালেন, তাঁদের ১০০ জনের একটি দল গত বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সমাবেশস্থলে এসে পৌঁছায়। রাতে মাঠেই ঘুমান। সেখানে খাওয়াদাওয়া করেন। গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর মাঠে লোকজন বেড়ে যায়। তাই তিনিসহ কয়েকজন মাঠ থেকে চলে আসেন। রাহেলার বাড়ির উঠানে বিছানা পাতেন। তাঁর মতো অনেকেই কোমরপুরের বিভিন্ন বাড়ির উঠানে, ঘরের বারান্দায় চাদর বা পাতলা কাঁথা পেতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান এরশাদ হোসেন।
বিএনপি রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে সমাবেশ করলে পুরো শহরে এর প্রভাব পড়বে, এটি তারা (আওয়ামী লীগ) দেখতে চায় না। এ জন্য তারা শহরে আমাদের সমাবেশ করতে দেয়নি। আমরাও এটা মেনে নিয়েছি শান্তির খাতিরে।এ কে কিবরিয়া, ফরিদপুর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব
বিছানাপত্রের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে এরশাদ হোসেন বলেন, ‘এই বিছানা (তোষক) আমার। এখানে এসে কিনেছি। এক পিস ২০০ টাকা। আর কাঁথা–চাদর বাড়ি থেকে এনেছি। অনেক দূর থেকে এসেছি, তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছি।’
অপরিচিত একজনের বাড়ির উঠানে এভাবে শুয়ে আছেন, তাঁরা কিছু বলেননি? এমন প্রশ্নের জবাবে এরশাদ হোসেন বলেন, ‘এখানে আসার পর আমরা জিজ্ঞেস করেছি, উঠানে বিছানা করে বিশ্রাম নিলে তাঁদের কোনো সমস্যা হবে কি না। তাঁরা বলেছেন, কোনো সমস্যা নেই, আপনারা থাকেন।’
এরশাদ হোসেনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন ওই বাড়ির গৃহকর্ত্রী রাহেলা বেগম। বয়স ৫০ পেরিয়েছে। রাহেলা বেগম ও তাঁর পুত্রবধূ রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় পার করছেন। চুলায় চা বসিয়েছেন। গণসমাবেশ ঘিরে বাড়ির সামনে ছোট একটি অস্থায়ী চা–দোকান করেছেন রাহেলার স্বামী ও ছেলে। বাড়ির রান্নাঘর থেকেই সরবরাহ করা হচ্ছে সেই চা। রাহেলা বেগম জানালেন, বাইরে থেকে আসা লোকজন বাড়ির উঠানে এসে থাকছেন বলে তাঁদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
ফরিদপুর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়া গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে সমাবেশ করলে পুরো শহরে এর প্রভাব পড়বে, এটি তারা (আওয়ামী লীগ) দেখতে চায় না। এ জন্য তারা শহরে আমাদের সমাবেশ করতে দেয়নি। আমরাও এটা মেনে নিয়েছি শান্তির খাতিরে।’
রাতে গণসমাবেশের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মঞ্চে কিছুক্ষণ স্লোগান, কিছু সময় বক্তৃতা আবার সময়–সময় গানবাজনা চলছে। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর ও বরিশালের গণসমাবেশের যে মেজাজ ছিল, তা ফরিদপুরে এসে অনেকটা উৎসবে রূপ নিয়েছে। মাঠের চারপাশ পাঁচ জেলার নেতাদের ছোট-বড় ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। নানা রঙের টুপি, টি–শার্ট গায়ে কর্মী-সমর্থকেরা সেখানে এসেছেন।
গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী থেকে আসা নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ সমাবেশস্থলের পাশের আবদুল আজিজ ইনস্টিটিউশন, কোমরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সেখানকার মসজিদের বারান্দায় উঠেছেন। আবদুল আজিজ ইনস্টিটিউশনের বারান্দায় কথা হয় রাসেল হাওলাদারের সঙ্গে। তিনি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থেকে এসেছেন। নিজ এলাকায় ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান। রাসেল বলেন, এখাবে থাকতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে না।
পাশেই কোমরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায় বড় একটি দল শুয়ে ছিল। সেখানে কথা হলো মাজেদ মাতব্বরের সঙ্গে। মাজেদ এসেছেন মাদারীপুরের ডাসার থেকে। তাঁর পাশে ছিলেন কাশেম শেখ। কাশেম শেখ এসেছেন রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার জয়গ্রাম থেকে। সঙ্গীদের সঙ্গে সেখানে বেশ আমুদে সময় কাটাতে দেখা গেল মাজেদ ও কাশেমকে।
জিজ্ঞেস করা হলে কাশেম শেখ বলেন, ‘এখানে এসে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, পরিচয় হয়েছে। সবার সঙ্গে বেশ আনন্দেই আছি। তবে মনে ভয়, বাড়ি গেলে তো ভাঙচুর হতে পারে।’
এত কষ্ট করে, এত ঝুঁকি নিয়ে কেন গণসমাবেশে এলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে কাশেম শেখের চটজলদি জবাব, ‘গত ১৪ বছরে দেশের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঘরে পাট পড়ে আছে। ৩ হাজার, ৩ হাজার ২০০ টাকার পাট এখন ২ হাজার ২০০ টাকায় বেচা লাগে। গত ঈদে খাসি কোরবানি দিছি। ১৭ কেজি গোশত পাইছি, কিন্তু চামড়া দিছি মাগনা। কোনো দাম পাইনি। আখ চাষ করেছিলাম, খেত থেকে কেটে নিয়ে গেছে। কোনো বিচার নাই। এইভাবে আর কত। তাই আমরা এখানে আইছি পরিবর্তনের আশায়।’
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় ফরিদপুরে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশস্থলে এসেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। মহাসচিবের সঙ্গে রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গণসমাবেশের প্রধান সমন্বয়কারী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন, বিএনপির দুই সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাশুকুর রহমান, মো. সেলিমুজ্জামান প্রমুখ।