শেষ আষাঢ়ের সকালটি শুরু হয়েছিল ঝুম বৃষ্টিতে। এরই মধ্যে কেউ ছাতা হাতে, আবার কেউবা কাকভেজা হয়ে আসে মিলনায়তন চত্বরে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমি চত্বর কৃতী শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে।
এখানেই আজ শুক্রবার উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘শিখো’র পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রথম আলোর আয়োজনে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সকাল সাড়ে আটটার আগেই শিক্ষার্থীদের হইহুল্লোড়ে সেখানে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। সহপাঠীরা একে অপরকে দেখে জড়িয়ে ধরে কুশল বিনিময় করে। কেউ সেলফি তোলে, কেউ স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে গল্প-আড্ডায় মেতে ওঠে। বিদ্যালয়ের পাট চুকানোর কয়েক মাস পর সহপাঠী ও বন্ধুদের দেখা পেয়ে তারা ভীষণ উচ্ছ্বসিত। সঙ্গে অনেকের অভিভাবকও আসেন। অভিভাবকদের উৎসাহও ছিল চোখে পড়ার মতো। উৎসবে খুলনার বিভিন্ন উপজেলার জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ১ হাজার ৪৭৫ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।
সকাল ৯টায় নির্ধারিত বুথ থেকে ক্রেস্ট, স্ন্যাক্স ও উপহার সংগ্রহের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের মূল মিলনায়তনের বাইরে অভিভাবকেরা বসে ছিলেন। তাঁদের জন্য বড় পর্দায় পুরো অনুষ্ঠান দেখার ব্যবস্থা ছিল। অনুষ্ঠান উপভোগের পাশাপাশি তাঁরা বিনা মূল্যে শুক্রবারের প্রথম আলো পড়েন।
সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে মিলনায়তন কানায় কানায় ভরে যায়। ১০টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান পর্ব। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে গলা মেলান শিক্ষার্থী ও অতিথিরা। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর খুলনা প্রতিনিধি উত্তম মণ্ডল।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক অমিত রায় চৌধুরী। কৃতী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা বিস্তার ও শিক্ষার মান সংরক্ষণে গণমাধ্যম এগিয়ে আসছে, এটা খুবই একটা ভালো উদ্যোগ। আমি মনে করি, যার যোগ্যতা আছে, মেধা বুদ্ধি আছে, সে এগিয়ে যাবেই। এটাই সভ্যতার ধর্ম। প্রযুক্তির একটা বিপ্লব ঘটেছে। এখন অন্তর্জালের মাধ্যমে জ্ঞানের অসীম ভুবনে আমরা প্রবেশ করেছি। এতে কিছু ঝুঁকি অবশ্য আছে। আজকে অভিভাবকের জন্য চ্যালেঞ্জ, সমাজের জন্য চ্যালেঞ্জ, আজকের এই বাচ্চারা যেন অন্তর্জালে আসক্ত হয়ে মেধাকে অপচয় না করে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময় নিজেকে তৈরি করতে হবে, প্রস্তুত হতে হবে। উদ্ভাবনী মনটাকে কাজে লাগাতে হবে। সময় নষ্ট করার কোনো সময় কিন্তু এখন নেই।’
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘তোমরা এখানে এসেছ, কারণ, তোমরা সফল হয়েছ। সফল যখন কেউ হয়, তখন সে একা হয়ে যায়। তোমাদের সফলতার প্রথম ধাপ শুরু হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা কথা বলেছেন, ‘সফলতার দরকার আছে, তার চেয়ে বেশি দরকার সার্থকতা’। তেমনি তোমার জন্য যখন সমাজ সফল হয়, তোমার জন্য যখন দেশ সফল হয়, তখন তোমার সফলতা সার্থক। তোমরা এমন সফলতা অর্জন করবে, যার মধ্য দিয়ে দেশ সফল হয়, পৃথিবী সফল হয়। তোমরা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। তোমরা পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তোমরা সব সময় চিন্তা করবে, তোমার মুক্তি, তোমার সাফল্য যেন অন্যের জন্যও ভালো হয়।’
‘স্বপ্ন দেখো, জীবন গড়ো’ স্লোগানে সারা দেশের ৬৪টি জেলায় প্রথম আলোর আয়োজনে ও শিক্ষার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘শিখো’র পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয়েছে জিপিএ-৫ উৎসব। আয়োজনটি পাওয়ার্ড বাই বিকাশ এবং সহযোগিতায় থাকছে কনকর্ড গ্রুপ, ফ্রেশ, বহুব্রীহি, সানকুইক, কনকা-গ্রী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি., বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ শাখা ক্যাম্পাস, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, এটিএন বাংলা ও প্রথম আলো বন্ধুসভা।
উৎসবে কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০ জন গুণী শিক্ষককে সম্মাননা জানানো হয়। তাঁদের মধ্যে আটজন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা হলেন ফাতিমা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিস্টার শিখা গোমেজ, সরকারি জলমা চক্রাখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মৃদুল মণ্ডল, রূপসা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাহাবুর রহমান, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বর্ণকমল রায়, পল্লীমঙ্গল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ মো. রফিকুল ইসলাম, উদয়ন খুলনা জেলা পুলিশ স্কুলের প্রধান শিক্ষক শেখ মাকসুমুল হাকিম শাহিন, সেন্ট যোসেফ উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক মদন মোহন পাল ও পাইওনিয়ার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিদ্যুৎ ফৌজদার।
সম্মাননা পাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বর্ণকমল রায় বলেন, ‘এই জিপিএ-৫ জীবনের শেষ নয়। এটা জীবনের একটা ভিত্তি হলো। এটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করাটাই তোমাদের এখন আসল কাজ। এখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তোমাদের জীবনের সাফল্যের পেছনে যাঁদের ন্যূনতম অবদান আছে, তাঁদেরকে সব সময় স্মরণে রাখার চেষ্টা করবে। দেশ, জাতি, পৃথিবী তোমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।’
অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন খুলনা বন্ধুসভার সভাপতি অধ্যাপক তুহিন রায়। দিনব্যাপী এই আয়োজনে শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল ক্রেস্ট, ডিজিটাল সার্টিফিকেট, শিখোর পক্ষ থেকে বিশেষ শিক্ষাবৃত্তি, ফ্রেশ ব্র্যান্ডের স্ন্যাক্স, সানকুইকের ফ্রুট জুস, প্রথম আলো ই-পেপার (তিন মাস) ফ্রি সাবস্ক্রিপশন, প্রথমা ডটকমে অনলাইনে বই অর্ডারে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়, প্রথমা প্রকাশনের বিক্রয়কেন্দ্রে প্রথমা প্রকাশন ও প্র-প্রকাশনের প্রকাশিত বইয়ে ৩০ শতাংশ ছাড়, কিশোর আলো ও বিজ্ঞানচিন্তার ছয় মাসের প্রিন্ট সংস্করণের সাবস্ক্রিপশনে বিশেষ ছাড়।
খুলনা বন্ধুসভার সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম এম মাসুম বিল্যাহর উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য অতিথিদের অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যের পাশাপাশি ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রূপমের পরিবেশনা শিক্ষার্থীদের মাতিয়ে রাখে।
অনুষ্ঠানে আসা কৃতী শিক্ষার্থী স্বপীল আশরাফ বলে, ‘প্রাণবন্ত ও সাজানো-গোছানো এই অনুষ্ঠানে আসতে পেরে আমি গর্বিত। অতিথিদের দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য আমার জীবনে চলার পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করব। আর সাংস্কৃতিক পর্বটি ছিল অনেক আনন্দময়। সব মিলিয়ে যে প্রত্যাশা ছিল, এর চেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি।’