কুমিল্লার শ্রম বিক্রির হাটে মিলছে না কাজ
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা। কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় এলাকার টাউন হল মাঠের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে একদল শ্রমজীবী মানুষের জটলা। তাঁদের বেশির ভাগের সঙ্গে আছে টুকরি ও কোদাল। তাঁরা শ্রম বিক্রির জন্য সেখানে হাজির হয়েছে। কেউ এলেই গৃহস্থ বা খদ্দের ভেবে তাঁকে ঘিরে ধরছেন। তবে আগের মতো কাজ মিলছে না। সম্প্রতি বন্যার পর শ্রম বিক্রির হাটে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ভোরের আলো ফুটলেই শ্রম বিক্রি করতে আসা মানুষের উপস্থিতিতে সরগরম আর ব্যস্ত হয়ে ওঠে নগরের কান্দিরপাড় এলাকা। এখানে প্রতিদিনের শ্রম বিক্রির হাট বসে। সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে বানের পানি কমে গেলেও এখনো অনেক এলাকা পানির নিচে। যেসব এলাকা থেকে পানি নেমে গেছে, সেখানে ভেসে উঠছে বন্যার ক্ষত। এই বন্যার প্রভাব পড়েছে শ্রম বিক্রির হাটেও। বন্যার কারণে শ্রমিকদের কাজের জন্য নেওয়া হচ্ছে না, যার কারণে অনেকে শ্রম বিক্রি করতে না পেরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে কান্দিরপাড় এলাকার এ শ্রম বিক্রির হাটে কথা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে আসা শ্রমিক দুলাল মিয়ার সঙ্গে। ৩৫ বছর বয়সী দুলালের ঘরে স্ত্রী ও তিন সন্তান আছে। কাজ না করতে পারায় স্ত্রী ও সন্তানরা কষ্টে আছেন জানালেন দুলাল। তিনি বলেন, ‘বন্যা হামার কাজ কমায়া দিসে। হামরা অনক কষ্টত আছি। হামার খবর কেউ নেয় না।’
বেশ কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কান্দিরপাড়ের মতো প্রতিদিন ভোর থেকে এমন শ্রম বিক্রির হাট বসে নগরের শাসনগাছা, চৌয়ারা, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার, বিজয়পুর রেলগেট, সুয়াগাজী বাজার, বুড়িচং উপজেলার নিমসার বাজার, লালমাই উপজেলার বাগমারা বাজার, লাকসামের বিজরা বাজারসহ জেলার অন্তত ২০টি স্থানে। এসব হাট থেকে শ্রমিকদের চুক্তিতে কৃষি, রাজমিস্ত্রি এবং গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজের জন্য নেওয়া হয়। গত ১৯ আগস্ট থেকে জেলার বন্যা পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। তখন শ্রম বিক্রির হাটগুলোতেও ভাটা পড়ে। এ কারণে শ্রমিকরা অনেক কষ্টে দিন পার করছেন।
বন্যা হামার কাজ কমায়া দিসে। হামরা অনক কষ্টত আছি। হামার খবর কেউ নেয় না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলার শ্রমিকেরা ভিড় করেন এসব শ্রম বিক্রির হাটে। এই শ্রমিকদের কেউ কেউ আসেন দুই-এক মাসের জন্য। থাকার সুবিধা পেলে কিংবা গৃহস্থালিতে ভালো কোনো কাজ পেয়ে গেলে অনেকে থেকে যান বছরের পর বছর। আবার টানা কয়েক দিন কাজ না পেলে অনেক শ্রমিক এক হাট থেকে অন্য হাটে চলে যান নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে। ধান রোপণ ও ধান কাটার সময় হলে কুমিল্লায় প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কাজ পান। অন্য সময়ে দৈনিক ৪–৫ হাজার শ্রমিক কাজ করতে পারেন। তাঁদের বেশির ভাগই নির্মাণশ্রমিক। দিনে ৬০০–৮০০ পারিশ্রমিক পান নির্মাণ ও কৃষিশ্রমিকেরা। আর ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা চুক্তিতে বিক্রি হন গৃহস্থালির শ্রমিকেরা। মাসিক চুক্তিতেও অনেকে কাজ করেন। তবে বন্যার কারণে এখন আগের মতো পরিস্থিতি নেই। তাই অনেক শ্রমিক কম টাকাও শ্রম বিক্রি করছেন।
নীলফামারী ডোমার থেকে আসা কৃষিশ্রমিক মো. আলম বলেন, স্বাভাবিক সময়ে সকাল ৬টায় এলে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যেই বেশির ভাগ শ্রমিক কাজ পেয়ে যান। কিন্তু বন্যার কারণে কাজ কমে গেছে। ফলে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও অনেক শ্রমিক কাজ পাচ্ছেন না। এতে শ্রমিকেরা অনেক কষ্টে আছেন। জেলার প্রায় সব স্থানেই একই অবস্থা।
যাঁরা শ্রম বিক্রি করতে পারেন, তাঁদের দিন কেটে যায়। যাঁরা শ্রম বিক্রি করতে পারেন না, তাঁদের ফিরতে হয় শূন্য হাতে; সময় কাটে হতাশা ও শঙ্কায়।
ঠাকুরগাঁও থেকে আসা শ্রমিক মোরশেদ আলম বলেন, কাজ না পেলে এই শ্রমিকরা বিভিন্ন মেস, স্কুলের বারান্দা, রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম অথবা স্টেশন এলাকার কম দামি কোনো হোটেলে থাকেন। আবার নিয়মিত কাজ পেলে অনেক শ্রমিক মিলে বাসা ভাড়া নিয়ে অথবা মেসে থেকে যান। তিনি শহরের শাসনগাছা এলাকার একটি মেসে থাকেন। প্রায় এক মাস কাজ নেই। মেস ভাড়া দিতে পারেননি। বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানরা কষ্টে আছেন।
কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় এলাকায় শ্রমিকদের শ্রম বিক্রির জন্য অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। টাউন হলের বিপরীতে পূবালী চত্বর এবং টাউন হল মার্কেটের সামনের সড়কেও শ্রমিকদের অপেক্ষায় থাকার দৃশ্য চোখে পড়ে। যাঁরা শ্রম বিক্রি করতে পারেন, তাঁদের দিন কেটে যায়। যাঁরা শ্রম বিক্রি করতে পারেন না, তাঁদের ফিরতে হয় শূন্য হাতে; সময় কাটে হতাশা ও শঙ্কায়।