মৃত ব্যক্তির নামে কৃষিঋণ, ব্যাংকের নোটিশে হতভম্ব ১৪ পরিবার

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কেশবপুর শাখাছবি: প্রথম আলো

কেউ মারা গেছেন স্বাধীনতার আগে। কেউ কখনো ব্যাংকেই যাননি। অথচ তাঁদের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ১০ বছর আগে কৃষিঋণ নেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালে অনুমোদন করা সেই ঋণ পরিশোধের জন্য সম্প্রতি ওই ব্যক্তিদের ঠিকানায় ব্যাংকের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা নোটিশের চিঠি পেয়ে হতভম্ব হয়ে পড়েন।

সম্প্রতি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কেশবপুর শাখায় এমন ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীনতার আগে মারা যাওয়া অন্তত চারজনসহ মোট ১৪ জনকে এমন নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের নাম–ঠিকানা ব্যবহার করে ২০১৪ সালে বিভিন্ন পরিমাণে ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। কারও কারও নামে একাধিক ঋণ উত্তোলন দেখানো হয়েছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের মধ্যে ১২ জনের বাড়ি উপজেলার সূর্য্যমনি ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামে।

সাধারণত বিধি অনুযায়ী কোনো ঋণ অনুমোদনের আগে ব্যাংকের একজন মাঠ কর্মকর্তা ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি ও তাঁর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেন। সবকিছু ঠিক থাকলে তিনি শাখা ব্যবস্থাপকের কাছে ঋণের ব্যাপারে সুপারিশ করে থাকেন। ব্যবস্থাপক আবার যাচাই-বাছাই করে ঋণগ্রহীতার উপস্থিতিতে স্বাক্ষর বা টিপসই নিয়ে ঋণ অনুমোদন করেন।

এ ঘটনায় নোটিশ পাওয়ার পর ভুক্তভোগী ও তাঁদের স্বজনেরা কৃষি ব্যাংকের কেশবপুর শাখায় যোগাযোগ করেন। তাঁরা এটিকে ‘লুটপাটের মহোৎসব’ উল্লেখ করে ব্যাপারটি দ্রুত সুরাহা করার দাবি জানিয়েছেন। ব্যাংকটির শাখা কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ২০১৪ সালে কর্মরত মাঠ কর্মকর্তাকে তলব করার কথা জানিয়েছে। যদিও ওই কর্মকর্তা এখন অবসরে চলে গেছেন। তৎকালীন ব্যবস্থাপকও দেশের বাইরে চলে গেছেন। বিষয়টি যথাযথ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

ঋণ পরিশোধের নোটিশের অনুলিপি। যাঁদের নামে নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা দুজনই দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে মারা গেছেন। অথচ তাঁদের নামে ২০১৪ সালে ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে
ছবি–কোলাজ: প্রথম আলো

ব্যাংক ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালের ১১ ডিসেম্বর কৃষি ব্যাংকের কেশবপুর শাখার কার্যক্রম শুরু হয়। ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাউফলের সূর্য্যমনি ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের কেতাব উদ্দিন হাওলাদারের তিন ছেলে জবেদ আলী, হযরত আলী ও রহম আলী ২০১৪ সালে ওই শাখা থেকে কৃষিঋণ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে জবেদ আলীর নামে ২৫ ও ৩০ হাজার টাকার দুটি, হযরত আলীর নামে ৪৫ হাজার ও রহম আলীর নামে ৫০ হাজার টাকার ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জবেদ আলী ১৯৬০, হযরত আলী ১৯৬৫ ও রহম আলী ১৯৬৬ সালে মারা যান।

কালিকাপুর গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা মো. আবুল মৃধা (৭৫) ও মো. গোঞ্জর আলী হাওলাদার (৮২) জানান, জবেদ, হযরত ও রহম আলী বয়সে তাঁদের চেয়ে বড় ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে মারা যান। তাঁদের নামে ২০১৪ সালে ঋণ নেওয়ার কথা শুনে তাঁরা অবাক হয়েছেন। তাঁরা বলেন, ‘এ-ও সম্ভব! এভাবেই দেশে লুটপাটের মহোৎসব চলছে।’

জবেদ আলীর নাতি ফকরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর জন্ম ১৯৬৭ সালের ১ জুন। তিনি তাঁর দাদাকে দেখেননি। ২০১৪ সালে দাদার নামে নেওয়া ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়ে তিনিসহ পরিবারের সদস্যরা হতভম্ব হয়ে পড়েন।

কালিকাপুর গ্রামের আহম্মদ আলী হাওলাদারের ছেলে মো. জয়নাল হাওলাদার মারা যান ১৯৬৯ সালে। তাঁর নামে ২০১৪ সালে ৪০ হাজার টাকার কৃষিঋণ তোলা হয়েছে। জয়নালের ছেলে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য মো. আবুল বাশার (৬৪) বলেন, তাঁর বাবার মৃত্যুর সময় ব্যাংকের শাখাই ছিল না। ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়ে জানতে পারেন, বাবার নামে ২০১৪ সালে ঋণ তোলা হয়েছে।

কালিকাপুর গ্রামের মো. বাবুল মৃধা (৪৪) ঢাকায় থাকেন। তিনি কোনো দিন কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নেননি। তাঁর নামে কেশবপুর শাখা থেকে ২০১৪ সালে ১৭ হাজার ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। তাঁর ছোট ভাই ফারুক হোসেন মৃধার (৪২) নামে ৭৫ ও ১৭ হাজার টাকার দুটি ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। আবদুল করিম মৃধা নামের এক ব্যক্তির নামে ৩৫ হাজার টাকার ঋণ উত্তোলন দেখানো হয়েছে। গ্রাম কালিকাপুর উল্লেখ করা হলেও তাঁর বাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে রুস্তম আলী মৃধা। অথচ এ নামের কেউ কালিকাপুর গ্রামে নেই।

ভুক্তভোগী মো. মনির হোসেন বলেন, তিনি কোনো দিন ওই ব্যাংকে যাননি। অথচ তাঁর নামে ২০১৪ সালে ঋণ তোলা হয়েছে। ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাংক থেকে চিঠি পেয়ে বিষয়টি জানতে পারেন। এরপর কয়েক দফায় ব্যাংকে গিয়ে যোগাযোগ করেছেন। সেখানে দেখেন, ঠিকানা ঠিক থাকলেও ছবি ও স্বাক্ষর তাঁর না।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য মো. আবুল বাশার। তাঁর বাবা জয়নাল হাওলাদার মারা যান ১৯৬৯ সালে। জয়নালের নামে ২০১৪ সালে ৪০ হাজার টাকার কৃষিঋণ তোলা হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

কৃষি ব্যাংকের কেশবপুর শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক হুসাইন মো. তাইফ আলম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি কেশবপুর শাখায় যোগদান করেন। সম্প্রতি ভুক্তভোগী পরিবারের কয়েকজন কার্যালয়ে এসে তাঁকে বিষয়টি জানান। এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ঋণগুলো ২০১৪ সালে অনুমোদন করা হয়েছে। তৎকালীন দায়িত্বে থাকা মাঠ কর্মকর্তাকে তলব করা হয়েছে। সেই সময় যিনি ব্যবস্থাপক ছিলেন, তিনি সম্ভবত দেশের বাইরে চলে গেছেন।

২০১৪ সালে কেশবপুর শাখার মাঠ কর্মকর্তা ছিলেন মো. শফিউর রহমান। পাঁচ বছর আগে তিনি অবসরে চলে গেছেন। জানতে চাইলে শফিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সালের ঋণ হলে তাঁর সময়ে হয়েছে। তবে তিনি ২০১৯ সালে অবসরে চলে গেছেন। তাঁর দাবি, তিনি কোনো মৃত ব্যক্তি কিংবা নামে-বেনামে কারও ঠিকানা ব্যবহার করে ঋণ দেওয়ার সুপারিশ করেননি।

জানতে চাইলে কৃষি ব্যাংকের পটুয়াখালীর মুখ্য আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক আশফাকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূর্য্যমনি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরাসহ সবাই জানেন, জবেদ আলীসহ ওই চারজন স্বাধীনতার আগে মারা গেছেন। তাহলে তাঁরা কীভাবে ঋণ নিতে পারেন? এমন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।