ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জামালপুরের ৫ উপজেলার ৩২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার আংশিক বন্যাকবলিত হয়েছে। সরকারি হিসাবে, এসব এলাকার প্রায় দুই লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দুর্গত এলাকার বেশির ভাগ মানুষ হতদরিদ্র। তাঁদের অভিযোগ, ছয় দিন ধরে তাঁরা পানিবন্দী থাকলেও পৌঁছায়নি কোনো ত্রাণসামগ্রী।
বানভাসিদের অভিযোগ, বেশির ভাগ গ্রামে তাঁরা এই ছয় দিনের মধ্যে কোনো জনপ্রতিনিধি বা সরকারি লোকজনকে খোঁজখবর বা ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে দেখেননি। কিন্তু জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, প্রতিদিনই দুর্গত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ফিরিস্তি দেখা যাচ্ছে। তবে গত চার দিন ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বেশ কিছু দুর্গত এলাকায় সরেজমিনে এমন কোনো চিত্র দেখা যায়নি।
আজ রোববার সকাল নয়টার দিকে আমতলী বাজারের মুদিদোকানি মো. শামীম হোসেনের (৪৫) সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ দিন ধরে আমতলী বাজারসহ চারপাশে বানের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বাজারের বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। সবাইকে নৌকায় চলাচল করতে হচ্ছে। কোথাও কোনো কাজকর্ম নেই। সবাই এখন বেকার।
শামীম হোসেনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইজিবাইকচালক আলতাফ হোসেন। তাঁর বাড়ি ঢেংগারগড় গ্রামে। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘গরিব মানুষের কষ্ট বোঝার ক্ষমতা ধনীদের নাই। বন্যার মধ্যে পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে আছি। সকালবেলা কাঁঠাল আর মুড়ি খেয়েছি পরিবারের সবাই। আজ খেতে পারব কি না, সেটা জানি না। পাঁচ দিন ধরে ইজিবাইক চালাতে পারছি না। সব রাস্তা ডুবে আছে।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য বলছে, জেলার বকশীগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার ৩২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ২ লাখ ৩ হাজার ২৮ জন এই বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসব দুর্গত এলাকায় ৫০০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১০ লাখ টাকা ও ৪ হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৪৮০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৬ লাখ টাকা ও ৪ হাজার ৫০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে ২৩০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৪ লাখ টাকা ও ৪৫০ প্যাকেট শুকনা খাবার মজুত রয়েছে।
বন্যাদুর্গত মানুষের অভিযোগের বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. শফিউর রহমান বলেন, ‘পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী রয়েছে। দুর্গত এলাকার চাহিদা অনুযায়ী ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিনই ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। গতকালও (শনিবার) আমি দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছি। দুর্গম কিছু এলাকায় হয়তো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে সময় লাগছে। তবে বন্যাদুর্গতরা ত্রাণসামগ্রী পাচ্ছেন না, বিষয়টি ঠিক নয়।’
আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ইসলামপুর উপজেলার আমতলী, আমবাড়ীয়া, ঢেংগারগড়, সুরেরপাড়া, জারুলতলা, গুঠাইল, মাঝিপাড়া, খলিশাকুঁড়ি, চিনাডুলী, পূর্ব বামনা, পশ্চিম বামনা, বামনা, শিংভাঙা, হারগিড়া, দেলীরপাড়, দেওয়ানপাড়া, নতুনপাড়া; শনিবার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বেলতলী, রেলওয়ে স্টেশন এলাকা, বালুগ্রাম, মাঝিপাড়া, কেল্লাকাটা, ডাকাতিয়া, হলকারচর ও গুজিমারি ঘুরে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
এসব এলাকার বন্যাদুর্গত অসহায় মানুষ ক্ষোভ জানিয়ে বলেছেন, ঘরবাড়িতে পানি এবং রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ার পরও কোথাও কোনো ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে না। দুর্গত এলাকার বেশির ভাগ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। পানি কমতে শুরু করলেও ঘরবাড়ির চারপাশে পানি। কোথাও বের হওয়া যায় না। কেউ বাজারে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনবেন, সেই উপায় নেই। কারণ, নৌকা ছাড়া কোথাও যাওয়া যায় না। ফলে ঘরে থাকা বেশির ভাগ খাদ্যপণ্য ফুরিয়ে যাচ্ছে।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার গুজিমারি এলাকার আবদুল হাই ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘ঘরের মধ্যে কোমরসমান পানি। কাপড় ভিজে বের হইছি। চাল থাকলেও পাক (রান্না) করার উপায় নেই। বছরে বছরে এই অবস্থা। পাকশাক (রান্নাবারি) নেই। আল্লাহ একমুঠ মিলাইলে খাই, না মিলাইলে খাই না। কেউ কোনো কিছুই দেয়নি। কোঠাই (কোথায়) ত্রাণ দেয়, সেটাও জানি না।’
গুজিমারি গ্রামটি চুকাইবাড়ী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মুসলিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে প্রায় ৪০০ পরিবার ছয় দিন ধরে পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। গতকাল মাত্র ২০টি পরিবার ত্রাণসামগ্রী পেয়েছে। বন্যাদুর্গত মানুষের ক্ষোভের মুখে আছি।’
চুকাইবাড়ী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মুক্তাদির তাঁর ওয়ার্ডে ২০টি পরিবারের জন্য ত্রাণসামগ্রী পাওয়ার কথা জানালেন। অথচ তাঁর এখানে ৫০০ পরিবার আছে।
ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরো ইউনিয়নে ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। ৫ মেট্রিক টন চাল পেয়েছি। সেগুলো ১০ কেজি করে ৫০০ মানুষের মধ্যে বিতরণ করেছি। বাকি বন্যাদুর্গতদের মধ্যে কিছুই বিতরণ করতে পারিনি।’
জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কার্যালয়ের পানি পরিমাপক আবদুল মান্নান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার পানি কমে বিপৎসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানি কমছে ধীরগতিতে।