নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ
বিদেশে থেকেও নাশকতার মামলায় আসামি তাঁরা
৩২ নম্বর আসামি সালেহ মোহাম্মদ জানুয়ারি থেকে মালয়েশিয়ায় আছেন। ১৯ নম্বর আসামি মোমেন খান চিকিৎসার জন্য আছেন ভারতে।
চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়ায় যান সোনারগাঁয়ের তরুণ সালেহ মোহাম্মদ ওরফে শান্ত (২৯)। বর্তমানে তিনি সেখানে একটি রেস্তোরাঁতে কাজ করছেন। অথচ পুলিশ বলছে গত ২৮ অক্টোবর রাতে সোনারগাঁয়ের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে গাড়ি ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের একটি ঘটনায় তিনি জড়িত। এ ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় ৩২ নম্বর আসামি সালেহ।
সোনারগাঁ থানায় দায়ের করা মামলাটিতে কাঁচপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোমেন খান ১৯ নম্বর আসামি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিজের পেটের পীড়া ও স্ত্রীর পায়ের চিকিৎসা করাতে ১৯ অক্টোবর থেকে ভারতের চেন্নাইয়ে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই দম্পতি।
কেবল আসামির তালিকাই নয়, মামলার এজাহারের সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার সাক্ষীর বয়ানেরও কোনো মিল পাওয়া যায়নি। এ ধরনের মামলাকে ‘গায়েবি’ বলে উল্লেখ করে আসছে স্থানীয় বিএনপি। মামলার প্রধান আসামি সোনারগাঁ বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সেদিন নেতা–কর্মীদের নিয়ে ঢাকায় ছিলাম। অথচ পুলিশ বলছে আমরা সোনারগাঁয়ে নাশকতা করেছি। তারা বিদেশে থাকা ব্যক্তিদেরও মামলায় আসামি করেছে। আসলে কাল্পনিক ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মনগড়ামতো পুলিশ আসামি করেছে। এখন নেতা–কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ হয়রানি করছে।’
যা বলছেন বিদেশে থাকা ব্যক্তিরা
নাশকতার মামলায় নাম থাকার বিষয়টি ২৯ অক্টোবর বিকেলে জানতে পারেন সালেহ মোহাম্মদ। হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে প্রায় ১০ মাস হলো মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন। দেশে তাঁর বাবা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সালেহ বলেন, ‘পারিবারিক কারণেই আমি বিএনপি সমর্থক। কিন্তু কোনো দিন সক্রিয় রাজনীতি করিনি। এখন শুনছি পুলিশ বাদী হয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু অবাক হইনি। এটাই তো এখন দেশের রাজনীতি।’
এ প্রতিবেদককে বিদেশে থাকার সব কাগজপত্র ও প্রমাণও পাঠিয়েছেন সালেহ আহমেদ। একই মামলায় তাঁর বাবা কাঁচপুর ইউনিয়ন বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি পীর মোহাম্মদ ৩০ নম্বর আসামি। গ্রেপ্তার–আতঙ্কে কলেজপড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানান পীর মোহাম্মদ।
ভারতে থাকা মোমেন খানের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে অসুস্থতার জন্য তিনি কথা বলতে পারেননি। তাঁর বিদেশ যাওয়ার কাগজপত্র এ প্রতিবেদককে পাঠানো হয়। পরে তাঁর সঙ্গে থাকা স্ত্রী আসমা খানম প্রথম আলোকে বলেন, গত ২০ অক্টোবর থেকে তাঁরা ভারতের চেন্নাইয়ে আছেন। এখানে অস্ত্রোপচার শেষে আগামী মাসে দেশে ফেরার কথা। কিন্তু মামলার আসামি হওয়ার পর এখন তিনি স্বামীকে নিয়ে দেশে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন।
এজাহারের সঙ্গে মেলেনি সাক্ষীর বর্ণনা
কাঁচপুর সেতুর পূর্ব পাশের ঢালে গাড়ি ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নাশকতার অভিযোগে গত ২৯ অক্টোবর সকালে সোনারগাঁ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মহিবুল্লাহ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলাটিতে ৮৫ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৭০-৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারভুক্ত প্রায় সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত পরিবারের সদস্য।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ শেষে রাতে কাঁচপুর সেতুর পূর্ব পাশের ঢালে ঢাকা–সিলেট মহাসড়কে বাস ভাঙচুর করেন। এ সময় তাঁরা সরকার উৎখাতের জন্য ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ এলে আসামিরা পালিয়ে যান। এ সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আলামত হিসেবে কাচ, ইট ও লোহার টুকরা, বাঁশ ও প্লাস্টিকের পাইপ এবং স্কচটেপে মোড়ানো টিনের ভাঙা কৌটা জব্দ করে।
মামলায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুজন পথচারী এবং একজন পুলিশ সদস্যকে সাক্ষী করা হয়েছে। ওই পুলিশ সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে এ ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং অপর দুজন সাক্ষীর সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের।
তাঁরা সবাই জানিয়েছেন, ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যা কিংবা রাতে ওই এলাকায় লোকজনের জমায়েত, ককটেল বিস্ফোরণ ও বাস ভাঙচুরের কোনো ঘটনার কথা তাঁরা জানেন না। ওই দিন রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি সড়কে টায়ারে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে আগুনের ছবি তোলে এবং আগুন নেভায়।
মামলার এজাহারে নাম থাকা একজন সাক্ষী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ওই এলাকাতেই ছিলাম। রাস্তায় একজন আগুন দেওয়ার পর পুলিশ আইসা আগুন নিভায়। তখন পুলিশ আমারে বলে “আপনি একটা তদন্তে সাক্ষী দিবেন”।’ তারা তখন আমার নাম–ঠিকানা মোবাইল নম্বর নেয়।’
যা বলছে পুলিশ
মামলাটির বিষয়ে মামলার বাদী পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মহিবুল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। পরে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ-অঞ্চল) শেখ বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মামলা গায়েবি হওয়ার কোনো উপায় নেই। সেদিন ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজন নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাকি আসামিদের নাম যুক্ত করা হয়েছে। কেউ যদি নিজেদের মধ্যে বিরোধের কারণে বিদেশে থাকা নেতা–কর্মীর নাম দিয়ে থাকেন, তবে তদন্ত করে অভিযোগপত্র থেকে সেসব নেতা–কর্মীর নাম বাদ দেওয়া হবে।