লোডশেডিংয়ে পাবনার বেড়ার তাঁতিদের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে
জেনারেটরের সাহায্যে পাওয়ার লুম ও তাঁত কারখানা সচল রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাতে খরচ বাড়ছে।
পাবনার বেড়া উপজেলায় তাঁতশিল্পে এমনিতেই দুঃসময় চলছে। এর ওপর ঘন ঘন লোডশেডিং তাঁতিদের জন্য ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে শাড়ি-লুঙ্গির চাহিদা থাকলেও লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানাগুলোতে কাপড় উৎপাদনে ধস নেমেছে।
কারখানার মালিকেরা ডিজেলচালিত জেনারেটরের সাহায্যে পাওয়ার লুম ও তাঁত কারখানা সচল রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এতে শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছা উৎপাদনে বাড়তি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এতে তাঁতিদের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে।
তাঁতমালিকেরা জানান, উপজেলার বনগ্রাম, হাতিগাড়া, হাটুরিয়া, জগন্নাথপুর, পেঁচাকোলা, রাকশা, আমিনপুর প্রভৃতি গ্রামে প্রায় পাঁচ হাজার তাঁত রয়েছে। সুতায় রং দেওয়া, শুকানো, সুতা তৈরি ও কাপড় উৎপাদনের জন্য প্রতিটি তাঁতে ৩-৪ জন শ্রমিকের প্রয়োজন। মালিক ও শ্রমিক মিলে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ এই শিল্পে জড়িত। এখানকার উৎপাদিত লুঙ্গি দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি হয়। এমনকি এই কাপড় বিদেশেও রপ্তানি হয়।
তবে চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় অধিকাংশ তাঁত কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে আগে যেখানে ১০ জন শ্রমিক কাজ করতেন, বর্তমানে ৬ জন শ্রমিক কাজ করছেন। এতে কাপড়ের উৎপাদন কম হচ্ছে। এ ছাড়া গত দুই মাসের ব্যবধানে লুঙ্গির দাম ২৫-৩০ শতাংশ কমে গেছে। ফলে সব মিলিয়ে কাপড় উৎপাদনের এই ভরা মৌসুমেও বাধ্য হয়ে অনেকে তাঁত কারখানা বন্ধ রাখছেন।
তাঁতিরা জানান, সুতা, রংসহ কাপড় উৎপাদনের প্রতিটি উপকরণের দাম বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় উৎপাদিত শাড়ি ও লুঙ্গির দাম না বেড়ে উল্টো কমেছে। গত ঈদুল ফিতরের সময় যে লুঙ্গি ২২৫-২৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেই লুঙ্গির দাম এখন ১৫০-১৬০ টাকা। অথচ গত বছরের ১১ হাজার টাকা দামের এক ডোপ সুতার দাম এখন ২০ হাজার টাকায় উঠেছে। এ অবস্থায় তাঁত চালু রাখতে গিয়ে এমনিতেই লোকসান গুনতে হচ্ছে তাঁতিদের।
বেড়া পৌর এলাকার হাতিগাড়া মহল্লার তাঁতশ্রমিক আক্তার হোসেন বলেন, ‘একটা লুঙ্গি বুনি ২৫ টাকা পাই। কারেন্ট থাকলি সারা দিনে ৮-১০টা লুঙ্গি বোনা যায়। কিন্তু বারবার কারেন্ট যাওয়ায় এখন তিন-চারটার বেশি লুঙ্গি বুনব্যার পারি না। সামনে ঈদ। অথচ দিনে ১০০ টাকা কামাইও হতিছে না।’
একই মহল্লার মো. মাসুদের বাড়িতে তিনটি তাঁত রয়েছে। লোকসানের মুখে তাঁত বন্ধ করে রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু ঈদুল আজহায় লাভ হতে পারে ভেবে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বন্ধ তাঁতগুলো আবার চালু করেছেন। কিন্তু কাপড়ের দাম কমে যাওয়ার সঙ্গে লোডশেডিং যোগ হওয়ায় আগের চেয়েও বেশি লোকসান দিতে হচ্ছে তাঁকে।
আক্ষেপ নিয়ে মাসুদ বলেন, ‘মহাজনের কাছ থিক্যা বাকিতে রং, সুতা আনছি। এখন না পারতেছি তাঁত বন্ধ করব্যার, না পারতেছি কাজ শেষ করব্যার। তাঁতে ওঠানো কাপড় বোনা শেষ হলি আবারও সব তাঁত বন্ধ কইর্যা দেব। এর চাইতে রাজমিস্ত্রির কাজই ভালো।’
সাধারণত ঈদ সামনে রেখে বন্ধ থাকা তাঁত চালু হয়। তবে এবার বেশির ভাগ তাঁতই চালু হয়নি। উল্টো চালু থাকা তাঁতগুলোই বন্ধ হতে শুরু করেছে।
হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের মালদাপাড়া গ্রামের তাঁতি একরাম হোসেন বলেন, মালদাপাড়া ও পাশের পেঁচাকোলা গ্রামে পাঁচ হাজারের বেশি তাঁত ছিল। এখন মাত্র কয়েক শ তাঁত চালু আছে। লোডশেডিং ও কাপড়ের দাম কমার কারণে এসব তাঁতও বন্ধের পথে। গত ঈদেও যেসব তাঁতি প্রতি সপ্তাহে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা রোজগার করেছেন, এখন তাঁদের এক হাজার টাকা রোজগার হওয়াই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২–এর বেড়া কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) হাবিবুর রহমান বলেন, এই কার্যালয়ের অধীন গত কয়েক দিনে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪-১৫ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ ছিল ৮-৯ মেগাওয়াট। তবে আজ (গতকাল) বিদ্যুতের সরবরাহ বেড়েছে।