গ্রাহকের টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক উধাও, সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
তাঁদের কেউ বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন, কেউ ভ্যানচালকের স্ত্রী, কেউ গৃহিণী ও দিনমজুর। তাঁদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরও আছেন। তাঁরা কষ্টার্জিত টাকা লাভের আশায় জমা করেছিলেন বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানে।
কেউ এককালীন টাকা দিয়ে মাসে মাসে লাভ নিচ্ছিলেন, কেউবা মাসে মাসে লাভের আশায় টাকা জমা করছিলেন। কিন্তু এখন লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকা পাবেন না বলে তাঁরা আশঙ্কা করছেন। কারণ, প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক পরিবার নিয়ে ১২ নভেম্বর পালিয়ে গেছেন। গ্রাহকদের অভিযোগ, নির্বাহী পরিচালক তাঁদের ৫০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন।
ওই টাকা ফিরে পাওয়ার দাবিতে কয়েক হাজার গ্রাহক আজ রোববার নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড়ে প্রধান সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ–মিছিল করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা চলে এই অবরোধ, এতে তৈরি হয় যানজটের। এ সময় তাঁরা নিজেদের টাকা উদ্ধারে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন এসে নাজিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলে আন্দোলনকারীরা অবরোধ প্রত্যাহার করে চলে যান।
এ বিষয়ে জানতে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন বলেন, বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের গ্রাহকদের পাওনা টাকার বিষয়টি নিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন গ্রাহকদের ধাপে ধাপে টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে তিনি পালিয়ে গেছেন। তাঁকে ধরার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নাজিম উদ্দিন পালিয়ে গেছেন জানতে পেরে তাঁরা নওগাঁ সদর থানা ও নওগাঁ আদালতে একাধিক মামলা করেছেন। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তাদের কাছেও একাধিকবার অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু এখনো নাজিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
আজ বেলা ১১টার দিকে মুক্তির মোড়ে গেলে ভুক্তভোগী কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের ভাষ্য, নওগাঁ ছাড়াও পাশের জয়পুরহাট, রাজশাহী ও বগুড়া জেলায় বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন নামের এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। এর মধ্যে ৪ হাজার ৩০০ গ্রাহকের পাওনা হিসাব করে ৫০০ কোটি ৮০ লাখ টাকার হিসাব পাওয়া গেছে। সব সদস্যের পাওনা টাকার পরিমাণ জানা গেলে এই টাকার পরিমাণ আরও বেশি হবে।
খোঁজ নিয়ে এবং কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন ২০০৯ সাল থেকে নওগাঁর বিভিন্ন এলাকায় অফিস খুলে ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। পাশাপাশি ব্যাংক ও সংস্থাগুলোর চেয়ে বেশি মুনাফা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে মাসিক ও বার্ষিক আমানত প্রকল্প, স্থায়ী বিনিয়োগ ও স্থায়ী আমানতের বিপরীতে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা জমা নিতে শুরু করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। টাকা জমা রেখে গ্রাহকদের প্রতি মাসে মুনাফা দিতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুর দিকে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে আমানতের বিপরীতে গ্রাহকদের লভ্যাংশের টাকা নিয়মিত দিত প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু গত জুলাই থেকে প্রতিষ্ঠানটির লোকজন গ্রাহকদের আমানত ফেরত ও লভ্যাংশের টাকা দিতে টালবাহানা শুরু করেন। মুনাফা ও আমানতের টাকা না পেয়ে কিছু গ্রাহক সেনাবাহিনীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সেনাবাহিনীর মধ্যস্থতায় গ্রাহকদের টাকা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও চেয়ারম্যান। কিন্তু ১২ নভেম্বর সংস্থার সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে তাঁরা লাপাত্তা হয়ে যান।
এ ঘটনার পর গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদকে ১৫ নভেম্বর বগুড়া শহর থেকে আটক করে সেনাবাহিনীর একটি দল। পরবর্তী সময়ে তাঁকে নওগাঁ সদর থানার পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হলে পুলিশ তাঁকে প্রতারণার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়।
প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক জাহানারা বেগম (৬০) জানান, তাঁর স্বামী পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। কোনো সন্তান নেই। এখন তিনি মানুষের বাড়িত কাজ করে খান। বছর দুয়েক আগে বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া পাঁচ শতক জমি বিক্রি করে ২ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। মানুষের কথা শুনে লাভের আশায় সেই টাকা বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে জমা দেন। শুরুর দিকে মাসে মাসে ২ লাখে ৪ হাজার করে টাকা দিত। সেই টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাতেন ও ওষুধ কিনে খেতেন। কিন্তু গত জুলাই থেকে কোনো মুনাফা পাচ্ছেন না। মুনাফা দূরের কথা, মূলধনের ২ লাখ টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না এখন।
রানীনগর উপজেলা বেতগাড়ী গ্রামের বাসিন্দা জনাব উদ্দিন বলেন, তাঁর দুই ছেলে দুবাইপ্রবাসী। সেখানে কাজ করে দুই ছেলে বাড়িতে টাকা পাঠান। ছেলে-মেয়ে ও নাতিদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিদেশ থেকে ছেলেদের পাঠানো টাকা থেকে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে ধাপে ধাপে ৬০ লাখ টাকা জমা দিয়েছিলেন তিনি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাসে লাভের টাকাও পেয়েছেন। সমিতির কর্মকর্তারা পালিয়ে যাওয়ায় লাভ তো দূরের কথা, সঞ্চিত টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
জেলা সমবায় অধিদপ্তর ও সমাজসেবা অধিদপ্তর কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন সমবায় অধিদপ্তর ও সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন ছাড়াই এত দিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিয়ে সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছিল। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) সনদ ছিল না তাদের। এমআরএ সনদ ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে নিজেদের সমবায় সমিতি পরিচয় দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন।