জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছ কেটে ভবন নির্মাণের তোড়জোড়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এখন ১২টি স্থাপনার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে ছয়টি আবাসিক হলের কাজ শেষ হয়েছে। এসব স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে কাটা পড়েছে এক হাজারের বেশি গাছ। পরিকল্পনা ছাড়াই স্থাপনা নির্মাণ করায় গাছ কাটা পড়ছে বলে অভিযোগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। তাঁরা পাঁচ বছর ধরে মহাপরিকল্পনা করে ভবন নির্মাণের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এর মধ্যে আবার গাছ কেটে দুটি ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে দুই শতাধিক গাছ কাটা পড়তে পারে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বলছে, মহাপরিকল্পনার দাবির তোয়াক্কা না করে একের পর এক গাছ কেটে ভবন করা হচ্ছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, গত কয়েক বছর নির্বিচার গাছ কাটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্তুসংস্থান হুমকির মুখে পড়েছে। প্রশাসনের উচিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) করে এসব বিষয়ের সুরাহা করা। অন্যথায় ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের শেষের দিকে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ জন্য একটি টেকনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট কমিটি (টিএমসি) করা হয়েছিল। তবে তার আগে আবার গাছ কেটে জীববিজ্ঞান অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন এবং গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন নির্মাণের আয়োজন করেছে প্রশাসন।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের কার্যালয়ে যোগাযোগ করলে তিনি ব্যস্ত আছেন, কথা বলতে পারবেন না বলে জানান। পরে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১০ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াজেদ মিয়া গবেষণাগারের বিপরীতে ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়তলাবিশিষ্ট ১ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট এবং পদার্থবিজ্ঞান ভবনের পাশে জলাশয়ে গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের জন্য ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয় তলাবিশিষ্ট ১ লাখ ৩০ হাজার বর্গফুটের ভবন নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম।
ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধনের দিন দুপুরে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন না করে কোনো ভবন করতে দেওয়া হবে না জানিয়ে মানববন্ধন করেন ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের নেতা-কর্মীরা। এরপর থেকে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা।
গত রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, দুটি সম্প্রসারিত ভবন নির্মাণের জন্য চারপাশে টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা। ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাগারের সামনের সড়ক থেকে জীববিজ্ঞান অনুষদে যাওয়ার ইটের রাস্তা থেকে ইট তোলা হচ্ছে। দুটি এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির দুই শতাধিক গাছ আছে, যা ভবন নির্মিত হলে কাটা পড়বে।
ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের একাংশের সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মহাপরিকল্পনার জন্য তাঁরা আন্দোলন করছেন। তবে প্রশাসন দাবির তোয়াক্কা না করে একের পর এক ভবন করে যাচ্ছে। মহাপরিকল্পনা ছাড়া আর একটি ভবন নির্মাণ করা হলে উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবেন তাঁরা।
মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য গঠিত টিএমসির সদস্যসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, সব নিয়মকানুন মেনে ওই ভবন দুটি করতে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। মহাপরিকল্পনা না করে ভবন নির্মাণের বিষয়ে বলেন, প্রকল্পের আওতায় যেসব স্থাপনা হওয়ার কথা, এখন চারটি স্থাপনার কাজ শুরুই হয়নি। ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু না করলে বাজেট রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত যাবে। মহাপরিকল্পনা একটি দীর্ঘমেয়াদি কাজ। ইতিমধ্যে কমিটি কাজ শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
অপরিকল্পিত ভবনে ভোগান্তি
বিশ্ববিদ্যালয়ে যত্রতত্র ভবন নির্মিত হওয়ায় ইতিমধ্যে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। চার বছর আগে করোনাকালে শহীদ রফিক-জব্বার হল ও মওলানা ভাসানী হলের পাশে ছাত্রদের তিনটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হয়। একই জায়গায় পাশাপাশি নতুন তিনটি ভবন নির্মাণের কারণে শব্দদূষণ বেড়ে যায়। হলের সামনে রাস্তা দিয়ে নবনির্মিত শেখ রাসেল ও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হলের শিক্ষার্থীদের চলাচলে শব্দদূষণ ও নিরাপত্তা শঙ্কা ঘটতে পারে ভেবে রাস্তায় দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন শহীদ রফিক-জব্বার হলের শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি সেই দেয়াল ভাঙাকে কেন্দ্র করে তিন হলের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়ান। অন্যদিকে নবনির্মিত ছাত্রীদের তিনটি হল ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ঘেঁষে করায় যানবাহনের উচ্চশব্দে অতিষ্ঠ ছাত্রীরা। পড়াশোনায় ব্যাঘাতসহ তাঁরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না।
নবনির্মিত ফজিলাতুন্নেছা হলের ছাত্রী মির্জা মায়মুনা বলেন, হলের পাশে মহাসড়ক থাকায় যানবাহনের শব্দে পড়াশোনা করতে পারি না। জানালা বন্ধ রাখলেও শব্দ আসে। রাতে সব নিশ্চুপ হয়ে গেলেও বড় বড় গাড়ির শব্দে ঘুমানো যায় না। মাথাব্যথা করে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশের দাবি, যত্রতত্র ভবন নির্মাণ না করে যথাযথ পরিকল্পনা করে ভবন নির্মাণ করলে শিক্ষার্থীদের সমস্যায় পড়তে হতো না। নির্দিষ্ট দূরত্ব না রেখে পাশাপাশি ভবন করায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।