বিএনপি মামলা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে

চার জেলায় নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ১৩৮টি মামলা হয়। গ্রেপ্তার হন ৬৫০ জন।

বিএনপির লোগো

নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমে মামলায় কোণঠাসা হয়ে পড়েন সিলেট বিভাগের বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এসব মামলায় গ্রেপ্তার নেতা–কর্মীরা নির্বাচনের পর জামিন পেতে শুরু করলেও এখনো অনেকে কারাগারে আছেন। মামলাগুলো চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের।

বিভাগের চার জেলার বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলেন, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে জাতীয় নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত বিভাগের চার জেলায় অন্তত ১৩৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার এজাহারে নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা মিলিয়ে বিএনপির অন্তত ৩ হাজার ৮০০ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। গ্রেপ্তার হন ৬৫০ জন। তাঁদের মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ৫৪০ জন জামিন পেলেও এখনো কারাগারে আছেন ১১০ জন।

স্থানীয় বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের পর অধিকাংশ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে ছিলেন। এ কারণে যাঁরা ব্যবসায়ী কিংবা পেশাজীবী ছিলেন, তাঁদের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বেশি। যাঁদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁদের অনেকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন। তাই এখনো কারাগারে থাকা অনেক নেতা-কর্মীর পরিবারের সদস্যরা আর্থিকভাবে দুরবস্থায় পড়েছেন।

সিলেট জেলা যুবদলের সভাপতি মোমিনুল ইসলাম গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে। পেশায় আইনজীবী এই নেতা গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্ত হন। জামিনে মুক্ত হওয়ার আগের রাতে মোমিনুলের স্ত্রী হাজেরা আক্তার বলেন, তাঁর স্বামী পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কারাগারে থাকায় তাঁরা অর্থসংকটে পড়েছেন। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট পরিবারটি মোমিনুল ও তাঁর (হাজেরার) ভাইদের আর্থিক সহায়তায় চলেছে।

নির্বাচনের আগে বিভাগের আন্দোলন কর্মসূচি সমন্বয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি বলেন, স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে সরকার বিপর্যস্ত করতে চেয়েছিল। মামলা-গ্রেপ্তার উপেক্ষা করে সবাই রাজপথে ছিলেন। তবে দলের পক্ষ থেকে সবাইকে আইনগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

বিএনপির চার জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট জেলা ও মহানগরে ৭০টি মামলায় প্রায় দুই হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ৩৫০ জন গ্রেপ্তার হন। তাঁদের মধ্যে ২৫০ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

বিএনপি নেতাদের তথ্য অনুযায়ী, হবিগঞ্জ জেলায় ২৫টি মামলায় প্রায় ৫০০ জনকে আসামি করা হয়। এ জেলায় গ্রেপ্তার হন ১৫০ জন। এর মধ্যে ১৪৫ জনই জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। সুনামগঞ্জে ২৩টি মামলায় প্রায় ৯০০ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ১০০ জন গ্রেপ্তার হন। বর্তমানে সবাই জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। অন্যদিকে মৌলভীবাজার জেলায় ২০টি মামলায় প্রায় ৪০০ জনকে আসামি করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৫০ জন গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৫ জন জামিনে ছাড়া পান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের জামিন পেতে জাতীয়বাদী আইনজীবী ফোরাম ও দল-সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা মিলে ‘আইন সহায়তা সেল’ তৈরি করেন। এ সেলের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের বিনা খরচে আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়। স্থানীয় নেতারা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে এ সেল পরিচালনা করছেন। নেতা-কর্মীদের আইনগত সহায়তা দেওয়ার যাবতীয় খরচ এ সেলই জোগাচ্ছে।

সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম, মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান ও হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সেলিম আহমদ বলেন, ২৮ অক্টোবরের পর মামলা-হামলা-গ্রেপ্তারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও দলের নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠে ছিলেন। তবে এখনো যেসব নেতা-কর্মী কারাগারে আছেন, তাঁদের জামিন নিতে দল চেষ্টা করছে। এ ছাড়া এখনো দলের নতুন কর্মসূচি এলে পুলিশের হয়রানি বাড়ে।

সিলেট মহানগর ও জেলা আদালতে মামলার তারিখ, তথা মিস কেসের তারিখ পেতে এক থেকে দেড় মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
এমরান আহমদ, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক

এদিকে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা জানিয়েছেন, সব কটি মামলাই বিশেষ ক্ষমতা আইনে কিংবা বিস্ফোরক আইনে দায়ের করেছে পুলিশ। হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তবে সিলেট জেলায় গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের অনেকে এখনো কারাগারে আছেন।

কারাগারে থাকা সিলেট বিএনপির নেতাদের মধ্যে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আবদুল আহাদ খান, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব আফছর খান, মহানগর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ফজলে হাসান রাব্বীসহ অনেকেই আছেন। তাঁরা নির্বাচনের আগে গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হন।

গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের আইনগত সহায়তা দিতে সিলেটে যে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট সহায়তা সেল গঠন করা হয়েছিল, তার প্রধান সমন্বয়কারী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী। গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের পরিবারকে নানাভাবে সহায়তা করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেক নেতা-কর্মীকে একটি মামলায় গ্রেপ্তার করে অতীতে দায়ের হওয়া আরও একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। সিলেট মহানগর ও জেলা আদালতে মামলার তারিখ তথা মিস কেসের তারিখ পেতে এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এ ছাড়া এজাহারভুক্ত কাউকেই জামিন দেওয়া হচ্ছে না। তাই তাঁদের উচ্চ আদালতে যেতে হচ্ছে।’