বাবার স্মৃতির খোঁজে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ হবিবুরের কন্যা
‘বাবা হাত নাড়িয়ে চলে গেলেন। সেটাই বাবাকে শেষ দেখা। এর পর থেকে কেউ দরজার সামনে এসে শব্দ করলেই বাড়ির ছোট হিসেবে দরজা খুলে দিতাম। বাবাকে বাড়ির সবার থেকে প্রথম দেখব বলে সেই অনুভূতি নিয়ে যেতাম বারবার। কিন্তু বাবা আর এল না।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়িতে এসে গতকাল বৃহস্পতিবার বাবাকে স্মরণ করতে গিয়ে এ কথা বলেন মোনালিসা রহমান ওরফে ঊর্মি (৫৮)। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক শহীদ মোহাম্মদ হবিবুর রহমানের ছোট মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমপাড়ায় শিক্ষকদের কোয়ার্টারের ১৯ নম্বর বাড়ির ‘বি’তে থাকতেন। ১৯৮৫ সালে বাড়িটি ছাড়ার অনেক বছর পর এসে ছুঁয়ে দেখলেন তাঁর বাবার নানা স্মৃতি।
শহীদ হবিবুর রহমানকে ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল বিকেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জিপ গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এর পর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর দুই ছেলে ও চার মেয়ে। সেই মেয়েদের মধ্যে সবার ছোট মোনালিসা রহমান। যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স খুব বেশি ছিল না। তবে বাবার শেষ হাত নেড়ে যাওয়ার দৃশ্য আজও তাঁর মনে পড়ে।
মোনালিসা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৮৫ সালে তাঁরা বাসাটি ছেড়ে দেন। এরপর তিনি ঢাকায় উচ্চশিক্ষা নেন। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। এরপর ২০১০ সালে একবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। দূর থেকে বহু স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি দেখে চলে গিয়েছিলেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার মোনালিসা বাড়ি দেখার পাশাপাশি দিনব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক, শহীদ হবিবুর রহমান হল, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা ও বধ্যভূমিতে গিয়েছেন। কোথাও গিয়ে তিনি থমকে দাঁড়িয়েছেন, কোথাও গিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে হেসেছেন, কোথাও কেঁদে ফেলেছেন।
সকালে ক্যাম্পাসে এসে প্রথমেই যান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের পশ্চিম পাশে অবস্থিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকে। পরে বাবার নামে নির্মিত শহীদ হবিবুর রহমান হলে যান তিনি। হলের সামনে ‘বিদার্ঘ্য’ শিরোনামে তাঁর বাবার একটি আবক্ষ করা হয়েছে। সেখানে ছবি তোলেন, হলের ভেতরে গিয়ে বারান্দায় হাঁটেন। এরপর প্রাধ্যক্ষের কক্ষে গিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলেন।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মোনালিসা রহমান বলেন, ‘জিপ গাড়িতে কিছু আর্মি এসে ইংরেজি বলে বাবাকে নিয়ে গেলেন। তখন আমাদের বাসা থেকে জুবেরী ভবন দেখা যেত। গাছপালা ছিল না এমন। বাবাকে গেস্টহাউসের ওপরে ছাদে নিয়ে গেল। পরে নামিয়ে আনা হলো। বাবা দূর থেকে বাসার দিকে হাত নেড়ে বিদায় নিচ্ছিলেন, এটা বোঝা যাচ্ছিল। এটাই বাবাকে শেষ দেখা। এরপর আর তাঁর দেখা পাওয়া যায়নি।’ কথাগুলো বলতে বলতে চোখ মুছলেন তিনি।
দুপুরের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় যান মোনালিসা রহমান। সেখানে তাঁর বাবার ব্যবহৃত কোট, ছাতা, জুতা আর লাঠি রাখা আছে। বাবাসহ অন্য শহীদদের ছবি দেখতে গিয়ে একসময় কেঁদে ওঠেন তিনি। সেখানে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ। তিনি শহীদ মীর আবদুল কাইয়ূমের মেয়ে। পরে তাঁদের সঙ্গে এসে যুক্ত হন আরেক শহীদের সন্তান। তিনি তাঁর বাবাকে দেখেনইনি।
শহীদ মোহাম্মদ হবিবুর রহমানের কন্যা এরপর যান বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে অবস্থিত বধ্যভূমিতে। সেখানে ঘুরে ঘুরে দেখেন। তিনি বলেন, পরিবারের অন্য সদস্যদের ধারণা, তাঁর বাবাকে হয়তো হত্যার পর এই বধ্যভূমিতেই রাখা হয়েছিল।
মোনালিসা রহমান বলেন, ‘আমার বাবা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হবে। এখানে সব ধর্ম-বর্ণের, ভাষার মানুষ সম-অধিকার নিয়ে থাকবেন। কিন্তু আমরা আজকের যে বাংলাদেশ দেখছি, সেখানে অসাম্প্রদায়িকতার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমরা গভীর অন্ধকারের দিকে চলে যাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। এত অরাজকতা দেখে আমরা আর দেশে থাকতে চাইনি। কিন্তু সেই দেশের স্বপ্ন আমরা এখনো দেখি, যে স্বপ্ন আমার বাবা দেখেছিলেন, ৩০ লক্ষ মানুষ দেখেছিলেন।’