শিশুপ্রাণে রং ছড়ায় ‘রঙমহল’

খুলনা নগরের খালিশপুর চরেরহাট এলাকায় শিশু–কিশোরদের নিয়ে সংগীত অনুশীলনে ব্যস্ত রঙমহলের স্বেচ্ছাসেবকেরাছবি: সংগৃহীত

দলে তাঁরা জনা ত্রিশেক স্বেচ্ছাসেবী। বয়স ১৫ থেকে ২৫–এর কোঠায়। সুযোগ পেলেই যান পার্কে। শিশুদের বিনোদনের জায়গাটুকু গুছিয়ে দিয়ে আসেন। ছুটির দিনে শিশুদের জন্য গান গাওয়া, ছবি আঁকা, আবৃত্তির আয়োজন করেন। শিশুদের ‘ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ’ সম্পর্কে শেখান। হাসপাতালে গিয়ে দেখেন শিশুরা ঠিকঠাক সেবাশুশ্রূষা পাচ্ছে কি না। স্কুলে স্কুলে গিয়ে কিশোরীদের মাসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে পরামর্শ দেন। কোথাও বাল্যবিবাহ হচ্ছে শুনলে প্রশাসনের সহায়তায় ঠেকান সেই বিয়ে।
শিশুদের সামূহিক বিকাশে সহায়তা দেয় কিশোর–তরুণদের সংগঠন ‘রঙমহল’। খুলনা নগরের ১০টি ওয়ার্ডজুড়ে তাদের কার্যক্রম। জেলার বিভিন্ন স্থানেও আছে তাদের গঠনমূলক নানা কাজ। ওরা দিনবদলের কান্ডারি। ওদের স্লোগান, ‘আমরা এই বিশ্বের বুকে গড়ব রঙমহল, সৃষ্টির নব মঞ্চে মোরা করব দিনবদল’। ভালো কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছে রঙমহল। সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়ক আলভী শেখ গত বছরের ডিসেম্বরে ‘আন্তর্জাতিক ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড বাংলাদেশ-২০২২’ পেয়েছেন। ইউএনএফপিএ, ইউএনডিপিসহ বাংলাদেশ সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এই পুরস্কার দেয়।

শিশুরা ঠেকায় বাল্যবিবাহ

চলতি বছর ঈদুল ফিতরের পরের দিনের কথা। খুলনা নগরের খালিশপুরের একটি বাড়িতে চুপিসারে চলছিল একটি বিয়ের আয়োজন। কনে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বাল্যবিবাহের এই খবর পেয়ে ছুটে আসেন রঙমহলের সভাপতি সাবিনা আক্তার। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে ঘটনাটি জানান। খবর পেয়ে প্রশাসন এসে বাল্যবিবাহ ঠেকায়।
রঙমহলের কর্মীরা চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৯টি বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছেন। সব মিলিয়ে গত চার বছরে বাল্যবিবাহ ঠেকানোর সংখ্যা ১৩০।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ বিষয়ে সাবিনা আক্তার বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবকদের বাইরে আমাদের একটা নেটওয়ার্ক আছে। তাদের মাধ্যমে আমরা বাল্যবিবাহের খবর পাই। শুরুতেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জানাই। আমরা নিজেরা ঘটনাস্থলে যাই। ক্ষমতাবান লোকদের কারণে কোথাও যেতে না পারলে শিশু সহায়তা নম্বর ১০৯৮-এ কল করি।’

রঙমহলের শিশুরা আপনমনে আঁকে
ছবি: সংগৃহীত

কষ্ট থেকে সংগঠনের জন্ম

চোখের সমস্যা, গায়ের রং আর কথা বলা নিয়ে কটূক্তি শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন আলভী শেখ (১৯)। এখন পড়ছেন খুলনার সরকারি জয় বাংলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে। ছোটবেলার নেতিবাচক আচরণগুলো দাগ কাটে তাঁর মনে। সেই থেকে শিশুদের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা জাগে আলভীর।
২০১২ সালে ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালিত বন্ধু কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্য হন আলভী। দুই বছর পর তিনি ওই ক্লাবের দলনেতা হন। অংশ নেন বিভিন্ন প্রশিক্ষণে। সেখান থেকে তিনি বাল্যবিবাহের কুফল ও শিশু নির্যাতন সম্পর্কে জানতে পারেন।
আলভী শেখ জানান, একটা সময় প্রকল্পের আওতায় থাকা ক্লাবগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি স্থায়ী একটি সংগঠন করার কথা ভাবেন। ২০১৮ সালে চারজন মিলে গড়ে তোলেন রঙমহল। বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্লাবগুলোর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ভালো সাড়া পান। ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক, আর ৪৫ শিশুকে নিয়ে সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। কয়েক মাসের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে খুলনা নগরের ৪০০ শিশু রঙমহলের নানামুখী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত।
রঙমহলের কার্যক্রমের প্রশংসা করে খুলনা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাসনা হেনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলভী ও তাঁর সহযোগীরা ভালো কাজ করছেন। এ ধরনের কাজকে আমরা উৎসাহিত করি।’

আসে সব ধরনের শিশু

প্রথম দিকে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, শিশুদের ভালো ও খারাপ স্পর্শের বিষয় জানানোর কাজ করত রঙমহল। পরে তারা শিশুদের শরীর ও মনোজগতের সুষ্ঠু বিকাশের দিকেও নজর দেয়। নিজেদের কাজ সম্পর্কে সংগঠনটির সভাপতি সাবিনা আক্তার বলেন, ১০টি ওয়ার্ডে তাঁদের নির্ধারিত স্থান আছে। সেখানে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শিশু-কিশোরেরা জড়ো হয়। স্কুলের শিশুরা যেমন আসে, আসে কর্মজীবী ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাও। সেখানে শিশুরা ছবি আঁকে, গান গায়, আবৃত্তি করে। পাশাপাশি নানা বিষয়ে চলে গঠনমূলক আলোচনা। ক্লাসে ভালো কাজের শপথ নেয় তারা। ব্রতচারী শেখে। যেখানে-সেখানে ময়লা না ফেলাসহ পরিবেশ রক্ষার পাঠও দেওয়া হয়।
‘উদাস মন’ নামে একটা সঞ্চয় বাক্স আছে রঙমহলের। সংগঠনের সদস্যরা ওই বাক্সে চাঁদা দেন। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নানা আয়োজনে অংশ নিয়ে যে সম্মানী তাঁরা পান, সেটাও জমা রাখেন ওই বাক্সে। এভাবেই খরচ মেটান তাঁরা। নিয়মিত সভা করে তিন মাসের কর্মপরিকল্পনা বানান।

শিশুদের সমাবেশে বড়রা

‘শিশুরা দিন দিন গৃহবন্দী হয়ে যাচ্ছে। পড়ার চাপ, প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলছে। তাই শিশুরা যাতে আনন্দে বেড়ে উঠতে পারে, এ জন্য তাদের সৃজনশীলতা বিকাশে আমাদের মনোযোগ,’ বললেন সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পাপ্পু চৌধুরী। এর সঙ্গে যোগ করলেন, তাঁদের স্বেচ্ছাসেবকেরা হাসপাতাল পরিদর্শনেও যান। দেখেন, শিশু রোগীরা তাদের প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে কি না। কোনো সমস্যা থাকলে প্রশাসনের শরণাপন্ন হন।
বছরে একটি সমাবেশের আয়োজন করে রঙমহল। করোনার আগে তিনটি সমাবেশ হয়েছে। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, মেয়র, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আসেন এসব সমাবেশে। সেখানে শিশুরা তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরে।
সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে তরুণদের ওপরই ভরসা করতে হবে মন্তব্য করে খুলনায় সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি আইনজীবী কুদরত-ই-খুদা প্রথম আলোকে বলেন, এই শিশুরা সুসংগঠিত হয়ে তাদের ইতিবাচক উদ্যোগের মাধ্যমে আরও শত শত শিশুর উপকার করছে; এটা বড়দের জন্যও দৃষ্টান্ত। বড়দের উচিত তাদের উৎসাহিত করা, অনুপ্রাণিত করা।