আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করে দেওয়াসহ তিন দফা দাবিতে ছয় দিন ধরে অনশনে থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামিউল ইসলামের ওপর হামলা হয়েছে। তাঁকে বেধড়ক মারধরের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে করে তুলে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপসাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক গৌতমের নেতৃত্বে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা অনশনরত সামিউলের ওপর হামলা চালান। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কার্যকরী সদস্য রাব্বি, সহ-সম্পাদক মুরাদ, তারেক মীরকেও দেখা যায়।
হামলাকারীরা সামিউলের বিছানা, কাঁথা, বালিশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এ সময় স্যালাইন রাখার স্ট্যান্ড ভাঙচুর করা হয়। পরে সামিউলকে জোরপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে তুলে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান গৌতম। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী শিক্ষার্থীরা বাধা দিতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচি ও কয়েকজন ছাত্রীকেও মারধর করা হয়।
সৌমিক বাগচি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামিউলকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মারধর করে জোরপূর্বক অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিতে চাইলে আমরা কয়েকজন তাদের বাধা দিই। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা আমাকেসহ কয়েকজনকে বেধড়ক মারধর করে। তবে অন্ধকার থাকায় আমি তাদের শনাক্ত করতে পারিনি। তবে অবশ্যই তারা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।’
তবে অনশনরত শিক্ষার্থী সামিউলের ওপর হামলারে পেছনে ছাত্রলীগের কোনো হাত নেই বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, মীর মশাররফ হোসেন হলের অনশনরত ওই শিক্ষার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। তবে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে। সেখানে ছাত্রলীগের একজনও জড়িত নয়।’
ঘটনার এক ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান ঘটনাস্থলে আসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ঘটনা শুনে আমরা এসেছি। এখানে যেসব শিক্ষার্থী হামলা করেছে, তাদের আমরা শনাক্ত করতে পারিনি। তারা ছাত্রলীগ করে কি না, এটাও জানি না। কারা হামলা করেছে, আমরা তদন্ত করে বের করে ব্যবস্থা নেব।’
সামিউলের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপাচার্য নুরুল আলমের বাসভবনের সামনে রাত সোয়া ১২টায় অবস্থান নেন প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সামিউলও। পরে তাঁকে আবার চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।
সামিউল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ৪৯ ব্যাচ ও মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। গত বুধবার রাত থেকে তিনি মীর মশাররফ হোসেন হলের খেলার মাঠে অবস্থান নেন। তবে মঙ্গলবার সকাল থেকে তিনি হলের অফিসকক্ষের সামনে অবস্থান নেন। তাঁর অন্য দাবি দুটি হলো গণরুম বিলুপ্ত করা এবং মিনি গণরুমে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের আসন নিশ্চিত করা।
মঙ্গলবার দুবার সামিউলের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের উপপ্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা রিজওয়ানুর রহমান। হাসপাতালে গিয়ে সামিউলকে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন তিনি। প্রথম আলোকে রিজওয়ানুর বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) দুবার আমি তাকে (সামিউলকে) দেখেছি। তার রক্তচাপ ১০০/৬০ পর্যায়ে আছে। ওই শিক্ষার্থীর ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা) হয়েছে। তাকে দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে কয়েকটি পরীক্ষা করার জন্য বলেছি। পানিশূন্যতা হলে ইন্টারনাল অনেক ধরনের সমস্যা তার হতে পারে।’
জবাবে সামিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমার দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালে যাওয়া দূরে থাক, সামান্য চিকিৎসাও নেব না। আমার দাবি শিক্ষকেরা মানবেন, দৃশ্যমান করবেন, তারপরই কেবল চিকিৎসা নেব। আমি অনশনে বসেছি, আমি জানি আমার কী হতে পারে। প্রশাসন আমাকে বারবার আশ্বাস দিয়েও কার্যকর কিছু করছে না।’
সামিউলের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে হল প্রশাসন থেকে অছাত্রদের কক্ষে গিয়ে হল ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। অবৈধ শিক্ষার্থীদের বের করার জন্য তালিকা তৈরির কার্যক্রম চলমান আছে বলে জানিয়েছেন ওই হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. সাব্বির আলম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের নির্দেশে আমরা অছাত্রদের হল ছাড়ার জন্য কাজ করছি। অছাত্রদের বের করে হলের বৈধ শিক্ষার্থীদের আসন দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আজ (মঙ্গলবার) আমার নিজের বিভাগের একজন অবৈধ শিক্ষার্থীকে বের করে দিয়েছি।’