উপাচার্য নেই ১ বছর, রুয়েটে অচলাবস্থা

আটকে গেছে পরীক্ষা। সেশনজটের শঙ্কা। উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যেতে পারছেন না শিক্ষকেরা। শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন।

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) এক বছর ধরে নিয়মিত উপাচার্য নেই। দীর্ঘ সময় ধরে উপাচার্য না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে জটিলতা দেখা দিয়েছে। নিয়মিত ক্লাস চললেও আটকে গেছে পরীক্ষা। এ অবস্থায় সেশনজটের আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা।

এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য শিক্ষকেরা দেশের বাইরে যেতে পারছেন না। বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে দেখা দিয়েছে ধীরগতি।

অবশ্য শিক্ষার্থীদের আটকে থাকা পরীক্ষা নেওয়ার জন্য একজন ডিনকে গত সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি বিভাগে বিভাগীয় প্রধান না থাকায় সিংহভাগ শিক্ষার্থী মন্ত্রণালয়ের এই চিঠির সিদ্ধান্তের পরও পরীক্ষায় বসতে পারছেন না।

পরীক্ষা নেওয়া ও উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থীরা গতকাল দুপুরে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা বলেন, তাঁদের বিভাগীয় প্রধান নেই এক মাস ধরে। তিনি না থাকায় পরীক্ষা গ্রহণ এবং সংশ্লিষ্ট একাডেমিক কাজে জটিলতা দেখা দিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের জন্য সরকারের কাছে তাঁরা তিনবার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।

দীর্ঘ সময় ধরে উপাচার্য না থাকাটা খারাপ নজির উল্লেখ করে রুয়েটের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এর প্রভাব অনেক দিন থাকবে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা বিষয় ভেঙে পড়েছে। এখন কাউকে উপাচার্য করলেও সহজেই সবকিছু অতি দ্রুত সমাধান হবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১৮টি বিভাগে ৫ হাজার ৬৫০ শিক্ষার্থী রয়েছেন। বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষক আছেন ৩৪৭ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের সবারই কমবেশি সমস্যা হচ্ছে।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) আবু ইউসুফ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে তাঁরা উপাচার্য নিয়োগের জন্য আবেদন সরকারের কাছে পাঠিয়েছেন। কেন হচ্ছে না সেটি তিনি জানেন না।

যেভাবে জটিলতার শুরু

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুলাইয়ের শেষ দিকে নিয়মিত উপাচার্য রফিকুল ইসলামের মেয়াদ শেষ হয়। পরে ৩ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রুয়েটের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ অনুষদের ডিন মো. সাজ্জাদ হোসেনকে উপাচার্যের দৈনন্দিন কার্যসম্পাদনের দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়।

তবে চলতি বছর ২৮ মে পদোন্নতির দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন তিনি। তাঁকে নিয়োগের সময় শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষমতা দেওয়া হয়নি, এই কারণ জানিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে একাডেমিক পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।

গত ২২ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ সিরিজের (২০১৭ সালের) শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলন করেন। পরে বিভিন্ন অনুষদের ডিনদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন শিক্ষার্থীরা। ২ আগস্টের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরীক্ষার রুটিন দেওয়া হবে বলে শিক্ষকেরা আশ্বস্ত করেন। পরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত করেন। এরই মধ্যে গত সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে পুরকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিয়ামুল বারিকে একাডেমিক কার্যক্রমের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বিভাগীয় প্রধান না থাকায় সব বিভাগের সঙ্গে পরীক্ষায় বসতে পারছেন না দুই বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

আটকে আছে পদোন্নতি

রুয়েটের এক শিক্ষক মাস কয়েক আগে হাঁটুতে আঘাত পান। অস্ত্রোপচারের জন্য তাঁর ভারত যাওয়া দরকার। কিন্তু তিনি দেশের বাইরে যাওয়ার অনাপত্তিপত্র পাচ্ছেন না। নাম না প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত অস্ত্রোপচার না করলে সমস্যা হতে পারে। অন্য আরেকটি বিভাগের শিক্ষার্থীও চিকিৎসার কারণে অনাপত্তি না পেয়ে দেশের বাইরে যেতে পারছেন না।

বৃত্তি পেয়ে দেশের বাইরে যেতে পারছেন না এমন শিক্ষক আছেন ১৪ জন। এ ছাড়া শতাধিক শিক্ষকের পদোন্নতি আটকে আছে নিয়মিত উপাচার্য না থাকায়। তাঁদের কারও কারও পদোন্নতি আটকে আছে এক বছরের বেশি সময় ধরে।

একজন শিক্ষক বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্যের পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। এটা তাঁরা অনেকেই জানতেন না। পরে আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করেন। এখন নিয়মিত উপাচার্য নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের আর পদোন্নতি হচ্ছে না। এ অবস্থায় একাডেমিক কার্যক্রমও হোঁচট খেয়ে খেয়ে চলছে।

শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নেই। এ ছাড়া চলতি মাসেই আরও কয়েকটি বিভাগে বিভাগীয় প্রধানের পদ শূন্য হয়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে সিংহভাগ শিক্ষার্থী মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরও পরীক্ষায় বসতে না পারার আশঙ্কা রয়েছে। সেই শঙ্কা থেকেই গতকাল সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেন।

ওই শিক্ষার্থীরাও বলছেন, মন্ত্রণালয় রুয়েটের পরিস্থিতি না বুঝেই একজন ডিনকে শুধু একাডেমিক কার্যক্রমের দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তো বিভাগীয় প্রধানদের নিয়োগ দিতে পারবেন না। এতে রুয়েটের সিংহভাগ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসতে পারবেন না। তাঁরা দ্রুত সময়ের মধ্যে উপাচার্য নিয়োগের দাবি জানান।

জানতে চাইলে রুয়েটের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. সেলিম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একজন নিয়মিত উপাচার্য খুবই জরুরি। অন্তত তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক কাজ চালানোর জন্য কাউকে মন্ত্রণালয় দায়িত্ব দিতে পারে।

উন্নয়ন প্রকল্পেও মন্থরতা

রুয়েটে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১১টি ১০ তলা ভবনের কাজ চলছে। আগামী বছর পর্যন্ত এসব কাজের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া আছে। কিন্তু উপাচার্য না থাকায় উন্নয়ন কাজেও ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে। ঠিকাদারদের টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে কাজের গতি কমে গেছে। এ অবস্থায় কিছুদিন আগে ঠিকাদারেরা টাকার জন্য প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ে এসেছিলেন। রুয়েট কর্তৃপক্ষ বলছে, চলমান উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার জন্য শিগগির অর্থ ছাড়ের প্রয়োজন। এ অবস্থায় টাকা দিতে না পারলে কাজ থেমে যাবে।

রুয়েটের প্রকল্প পরিচালক অমিত রায় চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিত উপাচার্য না থাকলে অর্থছাড় দেওয়া যায় না। দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য থাকাকালেও খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি। কিন্তু তাঁর পদত্যাগের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়েছে। কাজের গতি নেই বললেই চলে। এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ হয়েছে।

দীর্ঘ এক বছর উপাচার্য না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক কথায় বলব, এটি দুঃখজনক, এটি হওয়া উচিত না। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিরও দায়িত্ব রয়েছে। তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করলে সেটি বিরাট ক্ষতি। তাদেরও কিছু একটা করা উচিত।’