পিরোজপুরে দুই আসনের সীমানা পরিবর্তন নিয়ে ভোটের রাজনীতিতে নানা আলোচনা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পিরোজপুরের দুটি আসনের সীমানা পরিবর্তন আনায় নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে আগামী নির্বাচনে একটি আসনে আওয়ামী লীগ ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। আরেক আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের শরিক জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন।
গতকাল প্রকাশিত নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পিরোজপুর-১ আসনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে পিরোজপুর-২ আসনে থাকা ইন্দুরকানি উপজেলা। আর পিরোজপুর-১ আসন থেকে কেটে নেছারাবাদ উপজেলাকে যুক্ত করা হয়েছে পিরোজপুর-২ আসনের সঙ্গে।
ফলে এখন পিরোজপুর-১ আসনের সীমানায় থাকছে পিরোজপুর সদর, নাজিরপুর ও ইন্দুরকানি উপজেলা। এ আসন থেকে বাদ পড়া নেছারাবাদ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভোটার–অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে নতুন যুক্ত হওয়া ইন্দুরকানি উপজেলা জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত। ফলে আগামী নির্বাচনে পিরোজপুর–১ আসনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সে ক্ষেত্রে এখানে সুবিধা পাবে বিরোধীরা।
অন্যদিকে পিরোজপুর-২ আসনে থাকছে কাউখালী, ভান্ডারিয়া ও নেছারাবাদ উপজেলা। ইন্দুরকানি উপজেলা বাদ দিয়ে এখানে নেছারাবাদকে যুক্ত করায় নাখোশ এ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। কারণ, নেছারাবাদে জেপির সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
সীমানা পরিবর্তনে আমরা খুশি হতে পারিনি। ভোটের কয়েক মাস আগে ইসির এ ধরনের সিদ্ধান্ত আমাদের হতাশ করেছে।
আওয়ামী লীগ, বিএনপির ও জামায়াতে ইসলামীর পাঁচজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর সদর, নাজিরপুর ও ইন্দুরকানি নিয়ে পিরোজপুর-১ আসনের সীমানা ছিল। ওই নির্বাচনে সদর ও ইন্দুরকানিতে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আওয়ামী লীগের প্রার্থীর চেয়ে ১০ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিলেন। তবে নাজিরপুর উপজেলায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চেয়ে ১৭ হাজার ভোট বেশি পাওয়ায় জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে এম এ আউয়াল।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তন করা হয়। তখন পিরোজপুর-১ আসন থেকে ইন্দুরকানি উপজেলা বাদ দিয়ে পিরোজপুর-২ আসনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। পিরোজপুর-১ আসনটি সদর, নাজিরপুর ও নেছারাবাদ নিয়ে গঠিত হয়। নাজিরপুর ও নেছারাবাদ উপজেলায় আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক থাকায় আসনটি দলটির জন্য ঝুঁকিমুক্ত আসন হিসেবে ধরা হতো। এখন নেছারাবাদের পরিবর্তে ইন্দুরকানি উপজেলা যুক্ত করায় জামায়াতে ইসলামীর জন্য সুবিধা হয়েছে। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদী।
পিরোজপুর জেলা যুবলীগের সবেক যুগ্ম আহ্বায়ক গোপাল বসু বলেন, গত সাড়ে চার বছরে শ ম রেজাউল করিম নেছারাবাদ উপজেলায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। এ জন্য সেখানে তাঁর জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে। এখন নেছারাবাদ উপজেলা বাদ দিয়ে ইন্দুরকানি উপজেলা যুক্ত করায় নতুন করে কাজ শুরু করতে হচ্ছে। তবে এ আসনবিন্যাসে তাঁরা চিন্তিত নন।
সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিম বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পিরোজপুর সদর ও ইন্দুরকানি উপজেলায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চেয়ে কম ভোট পান। নাজিরপুর উপজেলায় নৌকা বেশি ভোট পাওয়ায় এ আসনে নৌকা বিজয়ী হয়েছিল। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ের জন্য নাজিরপুরের ভোটাররা ভূমিকা রাখছেন।
নাম না প্রকাশের শর্তে পিরোজপুরে আওয়ামী লীগের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, নিজেদের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সুবিধার্থে আওয়ামী লীগের সাবেক একজন সংসদ সদস্য ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক একজন সাধারণ সম্পাদক চেয়েছিলেন নেছারাবাদ উপজেলা পিরোজপুর-২ আসনের সঙ্গে যুক্ত করা হোক। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে।
পিরোজপুর–১ ও ২ আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী নেই। এ কারণে বিএনপির এ আসনের সীমানা পরিবর্তন নিয়ে আগ্রহ নেই।
নেছারাবাদ প্রেসক্লাবের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, পিরোজপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টি (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জন্য নেছারাবাদ উপজেলা ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেছারাবাদ উপজেলায় জেপির সাংগঠনিক অবস্থান দুর্বল। এ উপজেলায় ১ লাখ ৮৮ হাজার ১৫৭ ভোট রয়েছে, যা ভান্ডারিয়া ও কাউখালী উপজেলার মোট ভোটারের কাছাকাছি। তবে নেছারাবাদ উপজেলা পিরোজপুর-২ আসনে যুক্ত হওয়ায় আওয়ামী লীগের জন্য ভালো।
পিরোজপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ব্যক্তিগত সহকারী মো. মেজবা উদ্দিন বলেন, ‘সীমানা পরিবর্তনে আমরা খুশি হতে পারিনি। ভোটের কয়েক মাস আগে ইসির এ ধরনের সিদ্ধান্ত আমাদের হতাশ করেছে। নতুন একটি উপজেলায় আমাদের এ সময়ের মধ্যে মাঠ গোছাতে হবে।’
বিএনপিদলীয় সূত্রে জানা গেছে, পিরোজপুর–১ ও ২ আসনে দলটির শক্তিশালী প্রার্থী নেই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ দলের শরিক জামায়াতে ইসলামী ও পিরোজপুর-২ লেবার পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এ কারণে বিএনপির এ আসনের সীমানা পরিবর্তন নিয়ে আগ্রহ নেই। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমরা আসন পুনর্বিন্যাস নিয়ে ভাবছি না। আমাদের এখন একটাই লক্ষ্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন।’
পিরোজপুর-১ ও ২ আসনের ১৭ জন সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। অধিকাংশ ভোটার মনে করেন, নতুন সীমানায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিম ও পিরোজপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জন্য বিজয়ী হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। রেজাউল করিমকে সদর ও ইন্দুরকানি উপজেলায় বিএনপি জামায়াতে ভোটব্যাংক মোকাবিলা করতে হবে। পিরোজপুর-২ আসনের আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জন্য নেছারাবাদ উপজেলার ভোট তাঁর পক্ষে টানা কষ্টসাধ্য হবে। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে নেছারাবাদ উপজেলার আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক মঞ্জুর বিজয় সহজ করে দেবে।
১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ছিলেন জেলা জামায়াতের বর্তমান আমির তোফাজ্জেল হোসেন। যোগাযোগ করা হলে তিনি সীমানা পরিবর্তন নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
অবশ্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতে ইসলামীর এক নেতা বলেন, পিরোজপুর-১ আসন জামায়াতে ইসলামীর শক্ত অবস্থান রয়েছে। দশম সংসদ নির্বাচনে ইন্দুরকানি উপজেলা এই আসন থেকে বাদ দেওয়ার কিছুটা ক্ষতি হয়েছিল। নতুন সীমানা জামায়াতের জন্য ভালো হবে।