সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছি, এমন মৃত্যু কাম্য ছিল না: ফারদিনের বাবা
‘সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছি। ভালো মানুষ হিসেবে সে দেশের জন্য অবদান রাখতে পারবে—তেমন একটি জায়গায় যাবে, সেটি চেয়েছি। এমন মৃত্যু কখনো কাম্য ছিল না।’
নিখোঁজের দুই দিন পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের (২৩) লাশ পেয়ে এভাবেই বলছিলেন তাঁর বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা।
সোমবার রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের কেন্দ্রীয় খেয়াঘাট এলাকায় নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ থানার সামনে ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
ফারদিন নূর বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। কাজী নূরউদ্দিন বিজনেস পত্রিকা ‘দ্য রিভারাইন’–এর সম্পাদক ও প্রকাশক। ফারদিনের মা ফারহানা ইয়াসমিন। কাজী নূরউদ্দিনের তিন ছেলের মধ্যে সবার বড় ফারদিন নুর। মেজ ছেলে আবদুল্লাহ্ নূর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ছোট ছেলে তামিম নূর এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।
পড়াশোনায় মেধাবী ফারদিন এসএসসি ও এইচএসসিতে সব বিষয়ে জিপিএ–৫ পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছিলেন। গবেষণার বিষয়ে আগ্রহ ছিল তাঁর। নিজের ক্যারিয়ার নিয়েও সচেতন ছিলেন উল্লেখ করে কাজী নূরউদ্দিন বলেন, ‘ওর নিজের ইচ্ছায় বুয়েটে ভর্তি হয়েছে। আমরা ওরে স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করতে দিয়েছি। যেহেতু আমি সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলাম, তাই খুব একটা সচ্ছল ছিলাম না, ফারদিন নিজে টিউশনি করত। নিজের পড়াশোনা, পড়ানো, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আসা–যাওয়া ও সামাজিক কর্মকাণ্ড করত।’
ফারদিন সাঁতার জানতেন না জানিয়ে বাবা কাজী নূরউদ্দিন বলেন, এখানে তাঁর (ফারদিন) আসার কথা নয়। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে তাঁর ছেলেকে এখানে এনে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। তিনি ছেলে হত্যার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চান।
এদিকে ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তাঁর সহপাঠীরা। ফারদিনের সহপাঠী শরিফুজ্জামান শাফী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার সকালে ল্যাবে তাঁদের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা ছিল। শুক্রবার ফারদিন তাঁকে ফোন করে জানিয়েছিলেন রাতে হলে এসে থাকবেন। পরদিন সকালে পরীক্ষায় অংশ নেবেন। কিন্তু শুক্রবার ফারদিন বাসা থেকে বের হলেও হলে আসেননি এবং পরীক্ষায় অংশ নেননি। পরীক্ষা দিতে না আসায় তাঁরা পরিবারকে জানান।
শরিফুজ্জামান শাফী বলেন, ‘আমরা ন্যূনতম কোনো ক্লু খুঁজে পাচ্ছি না। ফারদিন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। ক্লাসে নিয়মিত আসা–যাওয়া করতে। ওর মৃত্যুর ঘটনার পর আমরা সবাই ভয়ে আছি। একটি মেধাবী ছিলে নিখোঁজ হয়ে যাবে, দুই দিন পর তার লাশ উদ্ধার হবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।’
ফারদিনের চাচা আবু ইউসুফ একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ফারদিন শুক্রবার বাসা থেকে বের হয়ে বিকেলে তাঁর এক মেয়েবন্ধুর সঙ্গে রিকশায় ধানমন্ডিতে একটি রেস্তোরাঁয় যান। সেখান থেকে তাঁরা নীলক্ষেত গিয়েছেন। সেখান থেকে তাঁরা আবার রাত পৌনে ৯টার দিকে বনশ্রীতে ওই মেয়েবন্ধুর বাসার কাছে গিয়েছেন। ওই মেয়েবন্ধু একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, ডিবেটিংয়ের সঙ্গে জড়িত।
আবু ইউসুফ বলেন, সুষ্ঠু তদন্ত ও যারা দোষী, তাদের বিচার চান তিনি। এ রকম ঘটনা আর যাতে না ঘটে। আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়। বুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি, তারা এ বিষয়ে সরকারের কাছে যেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত চায়, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়।
এদিকে নিখোঁজের পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের লাশ উদ্ধার করা হলে তাঁর সঙ্গে থাকা মুঠোফোন, ব্লুটুথ ও মানিব্যাগ সবকিছুই পাওয়া গেছে জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, লাশ ফুলে গেছে। শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে। তিনি বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, দু–এক দিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।
এ বিষয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ৪ নভেম্বর বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় তাঁর বাবা কাজী নুরুউদ্দিন রানা বাদী হয়ে রামপুরা থানায় জিডি করেছিলেন। সোমবার বিকেলে ফারদিনের লাশ বনানী ঘাটসংলগ্ন লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলের পেছনে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে তাঁর পরিচয় শনাক্ত হয়। ধারণা করা হচ্ছে, দু–এক দিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।