ভিডিওতে পুলিশের তাড়ায় ঢলে পড়তে দেখা মেয়েটির সঙ্গে কী হয়েছে
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ১৮ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, একটি মেয়ে পুলিশের তাড়ায় হঠাৎ ঢলে রাস্তার ওপর পড়ে গেছেন। সঙ্গে থাকা অন্যরা মেয়েটিকে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। এ সময় পুলিশ সেখানে যায়।
ভিডিওটি বগুড়ার সাতমাথা মোড় এলাকার বলে বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্ট-চেকিং এডিটর কদরুদ্দীন শিশির তাঁর ফেসবুকে উল্লেখ করেছেন। তবে ঘটনাটি কত তারিখের, সেটি উল্লেখ নেই।
ভিডিওটির বিষয়ে প্রথম আলো স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ঘটনাটি বগুড়ার সাতমাথা বীরশ্রেষ্ঠ স্কয়ার–সংলগ্ন ট্রাফিক আইল্যান্ড এলাকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালের ভিডিও এটি। বগুড়ায় এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজনকে ভিডিওটি দেখানো হলে তাঁরা স্থানটির বিষয়ে নিশ্চিত করেন। আর স্থানীয় লোকজন বলছেন, ভিডিওটি ঘটনাস্থলের পাশে এসআর ট্রাভেলসের কাউন্টারের সামনে থেকে ধারণ করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
এসআর ট্রাভেলস কাউন্টারের সহকারী ব্যবস্থাপক সাজ্জাদ চৌধুরী বলেন, ওই সময় বাস চলাচল বন্ধ ছিল। কাউন্টারও বন্ধ ছিল। তাই ভিডিওর ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।
বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগের শিক্ষার্থী জাকি তাজওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ১৮ জুলাই আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ যে মারমুখী ছিল, ভিডিওতে সেই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।’
বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের নেতা নিয়তি সরকারের ভাষ্য, ‘ভিডিওতে যে মেয়েকে দেখা যাচ্ছে, ওই মেয়ে ১৮ জুলাই বগুড়ায় বিক্ষোভে অংশ নেন। মেয়েটি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে মেয়েটি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। আমি নিজেও খবরটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার দিই। পরে জানতে পারি, মেয়েটির মারা যাওয়ার বিষয়টি গুজব।’
ঘটনাটি গত ১৮ জুলাইয়ের, এটি নিশ্চিত হওয়ার পর প্রথম আলো গণমাধ্যমকর্মীদের কাছ থেকে আরও কিছু ভিডিও সংগ্রহ করে। এতে দেখা যায়, ভিডিওতে হেলমেট ও পুলিশের ভেস্ট পরা ব্যক্তিরা বগুড়া জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এবং ৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) বগুড়ার সদস্য। গুলির শব্দ ও পরপরই মেয়েটি লুটিয়ে পড়ায় ডিবির কয়েকজন সদস্য সেখানে যান। এ সময় স্কুলের পোশাক পরা একজন আন্দোলকারী তাঁকে উদ্ধারে এগিয়ে এলে পুলিশের একাধিক সদস্য লাঠি হাতে তাকে তাড়া করেন।
এ বিষয়ে ডিবি বগুড়ার পরিদর্শক মুস্তাফিজ হাসানের ভাষ্য, গত ১৮ জুলাই সাতমাথা এলাকায় তিনি ছাড়াও ডিবি, সদর থানা ও এপিবিএনের সদস্যরা দায়িত্বে ছিলেন। ভিডিওটিতে যে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে, ওই মেয়ে ওই সময়ে গুলিবিদ্ধ হননি। সম্ভবত তিনি কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় অসুস্থ বোধ করছিলেন। পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে পানি পান করায়। মিনিট পাঁচেক পর তিনি নিজে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরে অন্য কোথাও মেয়েটি বুলেটবিদ্ধ হয়েছেন কি না, তা তিনি জানেন না।
আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রাতুল নামের একজন ওই মেয়ের নাম–পরিচয় নিশ্চিত করেন। ওই মেয়ের মুঠোফোন নম্বরও দেন। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে জানা যায়, মেয়েটির নাম নুসরাত জাহান (জেরিন)। পড়াশোনা করেন রাজধানীর বেসরকারি শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির সমাজবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্ব বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে।
নুসরাতের বাসা বগুড়ার উপশহর এলাকায়। গতকাল রোববার বিকেলে তাঁর বাসায় গিয়ে ভিডিওটি দেখানোর পর নুসরাত জাহান দাবি করেন, ১৮ জুলাই মিছিলে যোগ দেওয়ার পর তিনি সাতমাথায় পুলিশের হামলার শিকার হন। চারটি রাবার বুলেট বিদ্ধ হয় তাঁর শরীরে। প্রথমে তাঁকে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে এবং পরে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশের ভয়ে তিনি ওই সন্ধ্যায় হাসপাতাল ছেড়ে বাড়িতে চলে আসেন।
নুসরাতের বাবা জুয়েল আলম ব্যবসায়ী। মা নারী উদ্যোক্তা নাসরিন আলম। এই দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে নুসরাত জাহান বড়।
আন্দোলনে যোগ দেওয়ার বিষয়ে নুসরাত জাহান বলেন, ‘রংপুরে আবু সাঈদ হত্যার পর আর ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। মা–বাবার উদ্দেশে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে গত ১৮ জুলাই সকাল নয়টার দিকে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হই। দত্তবাড়ি থেকে সাতমাথার দিকে ছাত্রদের বিশাল মিছিল বের হয়। সদর থানার সামনে পুলিশ মিছিলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সাতমাথায় পৌঁছানোর আগে কয়েকটি কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। মিছিল নিয়ে আমরা সাতমাথায় পৌঁছামাত্র পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। মিছিল থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে প্রথমে জিলা স্কুলে আশ্রয় নিই। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাতমাথায় যেখানে ভিডিওটা করা, সেখানে পৌঁছালে একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব বাজে ভাষায় গালমন্দ করেন। পুলিশ ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে তেড়ে আসে। এ সময় একটি রাবার বুলেট ঊরুতে লাগলে ব্যথায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর সুস্থ বোধ করলে আবারও আন্দোলনে যোগ দিই। এ সময় পর পর কয়েকটি রাবার বুলেট পায়ে এসে লাগলে আহত হই। প্রথমে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে এবং পরে সেখান থেকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খবর পেয়ে পরিবারের লোকজন আসেন।’
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নুসরাতের ভর্তির কাগজপত্রে ‘পুলিশ অ্যাসাল্ট’ ও ‘রাবার বুলেট ইনজুরি’ লেখা আছে।
নুসরাত জাহান বলেন, হাসপাতাল থেকে বাড়িতে পৌঁছার পর রাতে তিনি জানতে পারেন যে তাঁর মৃত্যুর খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক বন্ধু তাঁকে কল করেন। তিনি তাঁদের নিজের বেঁচে থাকার কথা জানান।
বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) জাকির হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিডিওটি ইতিমধ্যে দেখেছি। ভিডিওটি ১৮ জুলাই বগুড়ার সাতমাথায় করা, সেটা সত্যি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশের সদস্যরা জানিয়েছেন, ওই দিন পুলিশের গুলিতে কেউ নিহত হননি। ওই মেয়েকে পুলিশ কোনো গুলি করেনি। কাঁদানে গ্যাসের শেলের আঘাতে মেয়েটি অসুস্থ হতে পারেন। মেয়েটি এখন সুস্থ আছেন বলে জেনেছি।’