রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসা এক শিক্ষার্থীকে ‘প্রক্সি চুক্তির’ (নিজের পরীক্ষা অন্যের মাধ্যমে দেওয়া) টাকার জন্য তুলে নিয়ে মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ পাওয়া গেছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে। অভিভাবকের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হল থেকে ওই শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে প্রশাসন। ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির কথা স্বীকার করায় তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে এ ঘটনায় আজ শুক্রবার সকালে নগরের মতিহার থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন। দুটি মামলাতেই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘প্রক্সি চক্রের’ সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীর ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়েছিল। যার বেশির ভাগ টাকা পরিশোধও করা হয়েছে।
অভিযুক্ত নেতারা হলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ ওরফে তন্ময়, শেরে বাংলা হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমদে, লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী মহিবুল মমিন ওরফে সনেট এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সাকোয়ান সিদ্দিক ওরফে প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণ কোনো পদে না থাকলেও ছাত্রলীগের মিছিলে তাঁকে দেখা গেছে। মুশফিকের বিরুদ্ধে এর আগেও ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতিতে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
ভর্তি হতে এসে আটক শিক্ষার্থীর নাম আহসান হাবীব। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বিজ্ঞান ইউনিটে মেধাতালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। সেই অনুযায়ী গতকাল দুপুরে বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত পপুলেশনস সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগে ভর্তি হন তিনি। তাঁর বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায়।
মতিহার থানা সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবদুস সালামের করা মামলায় ভর্তি পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের অভিযোগ আনা হয়েছে। সেখানে আহসান হাবীব ও ছাত্রলীগের চার নেতা–কর্মীসহ অজ্ঞাতনামা আরও দুই–তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি ও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে আরেকটি মামলা করেছেন ওই শিক্ষার্থীর মা রেহেনা বেগম। এই মামলায় ছাত্রলীগের ওই চার নেতা-কর্মীসহ অজ্ঞাতনামা আরও দুই-তিনজনকে আসামি করা হয়েছে।
আটক শিক্ষার্থীর মা রেহেনা বেগম বলেন, গত বুধবার দুপুরে ছেলেকে ভর্তি করার উদ্দেশ্যে রাজশাহী আসেন। গতকাল দুপুরে ছেলে তাঁকে বসিয়ে রেখে ভর্তি হতে যায়। কিন্তু বিকেল ৫টা বাজলেও ছেলে না এলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে নিখোঁজের অভিযোগ করেন। পরে তিনি জানতে পারেন, তাঁর ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হয়েছে। মুঠোফোনে ছেলের বাবার কাছে ৩ লাখ টাকা দাবি করেছেন। যাঁরা অপহরণ করেছেন, তাঁদের ছেড়ে দিয়ে প্রশাসন তাঁর ছেলেকে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
রেহেনা বেগম আরও বলেন, ‘আমার ছেলেকে কিডনাপ করল, সেই অভিযোগ নিয়েই তো আমি এখানে এসেছি। যদি আমাকে বলত যে সে জালিয়াতি করে এখনে ভর্তি হয়েছে, তাহলে তো আমি জেনেশুনে এখানে আসতাম না। আমার ছেলে যদি অপরাধ করে থাকে, তাহলে তার শাস্তি হোক। কিন্তু যারা আমার ছেলেকে গুম করে আটকে রেখেছিল, তাদেরও শাস্তি দিতে হবে।’
দুটি মামলার এজাহারের বর্ণনা প্রায় একই রকম। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রক্সি চক্রের একটি গ্রুপের সঙ্গে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা চুক্তি করেন আহসান হাবীব। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল রাজশাহী এসে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা নগদ ও ৬০ হাজার টাকার চেক পরিশোধ করেন তিনি। ভর্তির পর বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল। ভর্তি হওয়ার পর টাকা না দেওয়ায় ওই শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাস থেকে শেরে বাংলা হলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে শারীরিক নির্যাতন ও ছুরি দেখিয়ে খুন–জখমের ভয়ে দেখান আসামিরা। অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে আটক রেখে শিক্ষার্থীর বাবার কাছে আরও তিন লাখ টাকা দাবি করে ওই চক্র।
প্রক্টর দপ্তরে আনার পর আহসান হাবীব বলেন, সাকোয়ান সিদ্দিক ওরফে প্রাঙ্গণের সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষায় তাঁর প্রক্সির চুক্তি হয়। কিছু টাকা বাকি ছিল। তাই গতকাল ভর্তির পর প্রাঙ্গণ ও কিছু ছেলে মিলে তাকে শেরে বাংলা হলে নিয়ে যান এবং তিন লাখ টাকা দাবি করেন। বাড়িতে ফোন দিয়ে টাকা নিতে মারধরও করেছেন।
আহসান হাবীবের বাবা সাইফুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নিজ যোগ্যতায় ভর্তি পরীক্ষায় মেধাক্রমে আসার পরও একটা চক্র তাঁর ছেলের কাছে কৌশলে চাঁদা দাবি করছে। আর এই চক্রের মূলে রয়েছে মুশফিক তন্ময় (মুশফিক তাহমিদ) নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। শেরে বাংলা হলে তাঁর ছেলেকে আটকে রেখে মুশফিক এবং প্রাঙ্গণ পরিচয় দিয়ে তাঁর কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করেন। তাঁরা নানাভাবে হুমকি দিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে এই টাকাটা দিতে বলেন। তিনি টাকা দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। এ সময় তাঁদের কথাগুলো রেকর্ড করতে গেলে বুঝতে পেরে তাঁরা কল কেটে দেন।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এরপরও যদি আমার ছেলে দোষী প্রমাণিত হয়, তাহলে তার পাশাপাশি মুশফিক তন্ময় এবং প্রাঙ্গণ নামের এই দুই শিক্ষার্থীসহ জড়িত সবাইকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’
তবে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন শের বাংলা হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সনেট ও প্রাঙ্গণ এ ঘটনার মূল কারিগর। ওই শিক্ষার্থী প্রক্সির মাধ্যমে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে চুক্তিতে কিছু টাকা বাকি থাকায় আমার পাশের রুমে নিয়ে আসে। ঘটনা জানার পরে আমি তাঁদের হল থেকে বের করে দিই। পরে প্রভোস্ট স্যার ফোন দিয়ে বলেন, তাঁদের ডেকে আনতে। যেহেতু আমি হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা, এরপর তাঁদের ফোন দিয়ে ডেকে আনি এবং প্রভোস্ট স্যারের মাধ্যমে ওই শিক্ষার্থীকে প্রশাসনের কাছে তুলে দিই।’
অভিযুক্ত মুশফিক তাহমিদ, শাকোয়ান সিদ্দিক ও মহিবুল মমিনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও বন্ধ পাওয়া যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘এ ঘটনায় মুশফিক বলে একজনের নাম এসেছে। তবে সেই মুশফিক ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময় কি না, সেটা আমরা নিশ্চিত নই। তবে বিষয়টি আমরা তদন্ত করব। এতে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ নেওয়া হবে। আর এ ঘটনায় রাজু সম্পৃক্ত ছিল না।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, আটক শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হয়েছেন বলে তাঁদের কাছে স্বীকার করেছেন। এ ঘটনায় তাঁকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। চাঁদা দাবি বা আদায়ের সঙ্গে কারও কোনো সম্পৃক্ততা থাকলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।