রোজাদারদের অর্ধেক ভাড়ায় গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন রিকশাচালক
প্রায় তিন দশক ধরে রিকশা চালান মো. ইউসুফ (৪৫)। পবিত্র রমজান উপলক্ষে অর্ধেক ভাড়ায় তিনি রোজাদারদের গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন। পিরোজপুর শহরের এই রিকশাচালক আগামী ২০ রমজান পর্যন্ত অর্ধেক ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করবেন। রোজা উপলক্ষে তাঁর এই উদ্যোগ পিরোজপুরে ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে।
মো. ইউসুফের বাড়ি পিরোজপুর পৌরসভার রায়েরকাঠি গ্রামে। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। ছেলে ঢাকায় থাকেন। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। রোজা উপলক্ষে ১০ রমজান পর্যন্ত রোজাদারদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার একটি বার্তা তিনি রিকশার পেছনে সাঁটান। এরপর লেখাটি অনেকের নজরে আসে। তখন তিনি ২০ রমজান পর্যন্ত অর্ধেক ভাড়ায় যাত্রী পরিবহনের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর তিনি মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যাবেন বলে জানান।
মো. ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, রমজান মাসে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পণ্যের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। এটা জেনে তিনিও সিদ্ধান্ত নেন, ১০ রোজা পর্যন্ত রোজাদার যাত্রীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেবেন। পরে তা বাড়িয়ে ২০ রমজান পর্যন্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘রোজাদারদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিতে চাইলেও সবার কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিচ্ছি। কে রোজাদার আর কে রোজা রাখেনি, তা জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়। তাই সবার কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিচ্ছি।’
গত বুধবার দুপুরে পিরোজপুর শহরের রাজারহাট মহল্লায় ইউসুফের রিকশার পেছনে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার বার্তা এ প্রতিবেদকের নজরে আসে। রিকশার পেছনে লেখা আছে, ‘পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে রোজাদার যাত্রীদের জন্য ১০ রমজান পর্যন্ত হাফ ভাড়া নেওয়া হয়।’ তখন দুজন যাত্রী নিয়ে ইউসুফের শহরের সিও অফিস মোড়ে যাওয়ার তাড়া থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর সঙ্গে কথা হয়।
ইউসুফ জানান, ২৯ বছর ধরে তিনি রিকশা চালান। তিনি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও কম ভাড়া নেন। কোনো শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের হলে টাকা নেন না। এবার প্রথমে ১০ রমজান পর্যন্ত অর্ধেক ভাড়ায় রিকশা চালাতে চেয়েছিলেন। পরে তা ২০ রমজান পর্যন্ত বাড়ান। এরপর মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার কথা থাকায় রিকশা চালাতে পারবেন না। আগামী বছর বেঁচে থাকলে পুরো মাস অর্ধেক ভাড়ায় রিকশা চালাবেন।
রাজারহাট মহল্লায় এক নারী ছেলেকে নিয়ে শহরের সিও অফিস মোড়ে যাওয়ার জন্য ইউসুফের রিকশায় ওঠেন। রিকশায় ওঠার পর ইউসুফ যাত্রীকে বলেন, ‘সিও অফিস পর্যন্ত ভাড়া ৩০ টাকা। আপনি ১৫ টাকা দেবেন।’
রিকশা থেকে নামার পর ওই নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘উনি (ইউসুফ) না বললেও আমি নির্ধারিত ভাড়া ৩০ টাকা দিতাম। রিকশাচালক নিজ থেকে আমাকে অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার কথা জানালে প্রথমে আমি অবাক হই। পরে জানতে পারি, তিনি রমজান উপলক্ষে অর্ধেক ভাড়া নিচ্ছেন। বিষয়টি আমার কাছে ভালো লেগেছে।’
প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত রিকশা চালান মো. ইউসুফ। এরপর বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় ইফতারির পর আবার বের হন। রাত ১১টা পর্যন্ত রিকশা চালান। ইউসুফ বলেন, ‘রমজানের আগে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় ছিল। রোজা উপলক্ষে ছাড় দেওয়ার পরও আয় কমেনি। কারণ ভাড়া অর্ধেক নেওয়ায় যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এখন যাত্রী বেশি হওয়ায় প্রচুর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। বিশ্রাম নেওয়ার সময় পাওয়া যায় না।’
পিরোজপুর পৌরসভার শিকারপুর মহল্লার বাসিন্দা ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘গত মঙ্গলবার রাতে আমি ইউসুফের রিকশায় শহর থেকে বাসায় গিয়েছি। ভাড়া দেওয়ার পর তিনি আমাকে অর্ধেক টাকা ফেরত দেন। আমি টাকা ফেরত দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “রমজান উপলক্ষে অর্ধেক ভাড়া নিচ্ছেন।” রমজান উপলক্ষে একজন রিকশাচালকের এমন কাজ প্রশংসনীয়।’
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর পিরোজপুর জেলা শাখার সভাপতি খালিদ আবু প্রথম আলোকে বলেন, রমজান উপলক্ষে অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেখানে একজন রিকশাচালক যাত্রীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর এ কাজ অনুকরণীয় হওয়ার মতো। ইউসুফকে তিনি অনেক দিন ধরে জানেন। তিনি শিক্ষার্থী ও দরিদ্র মানুষের কাছ থেকেও কম ভাড়া নেন।