২৭ দিনেও সাগর থেকে না ফেরা ১৭ জেলের ভাগ্যে কী ঘটেছে

নিখোঁজ জেলে মো. খোকনের আইডি কার্ড হাতে মা ধলুবিবির আহাজারি। আজ দুপুরে কক্সবাজারের খুরুশকুলের কাউয়ারপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো।

কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর মাঝির ঘাট থেকে গত ২০ সেপ্টেম্বর ট্রলার নিয়ে সাগরে ইলিশ ধরতে গিয়েছিলেন ১৭ জেলে। আজ মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ২৭ দিনেও ১৭ জেলের খোঁজ মেলেনি। নানা দপ্তরে যোগাযোগ করে পরিবারের সদস্যরা জানতে পারছেন না, নিখোঁজ জেলেদের অবস্থা সম্পর্কে। এ নিয়ে উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা।

এফবি রামিম নামে ওই ট্রলারের মালিক কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়নের কাউয়ারপাড়ার খোরশেদ আলম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ১৭ জেলে নিয়ে তাঁর ট্রলারটি গত ২০ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় ইলিশ ধরতে গভীর সাগরের দিকে রওনা দেয়। নিয়মানুযায়ী, ১০ থেকে ১১ দিনের মধ্যে সাগর থেকে ট্রলারটি উপকূলে ফিরে আসার কথা। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হলে মাছ ধরার সব ট্রলার ঘাটে ফিরে আসে। কিন্তু তাঁর ট্রলারের খোঁজ মিলছে না। এ বিষয়ে ৩ অক্টোবর কক্সবাজার সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিবুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তখন বঙ্গোপসাগর প্রচণ্ড উত্তাল হয়ে পড়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ট্রলারটি মিয়ানমার অথবা ভারতের দিকে ভেসে গেছে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ট্রলারটির অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ডসহ অন্যান্য বাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

নিখোঁজ ডায়েরিতে বলা হয়, ট্রলারের থাকা জিপিএস ট্র্যাকিংয়েও এর অবস্থান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

জেলেদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা না জানায় তাঁদের পরিবারের সদস্যরা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছেন।  

কক্সবাজার জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নিখোঁজ ট্রলারের সন্ধান মেলেনি। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার প্রভাবে ট্রলারটি গভীর সাগরে ডুবে গেছে, নাকি প্রতিবেশী দেশের জলসীমায় চলে গেছে, তা জানা যায়নি এখনো।  

স্বজনদের অপেক্ষা

নিখোঁজ ১৭ জেলের একজন নাসির উদ্দিন (২৯)। বাড়ি কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়নের পালপাড়ায়। বিয়ে করেছেন ৯ মাস আগে। বড় ভাই বশির আহমদের ঘরে স্ত্রীকে রেখে ২০ সেপ্টেম্বর ট্রলার নিয়ে সাগরে নামেন ইলিশ ধরতে।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে তাঁর ঘরে গিয়ে দেখা গেছে, ছেলের জন্য কান্নাকাটি করছেন নাসিরের মা মনজুরা বেগম (৫০)। ভেতরের কক্ষ থেকে কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসেন তাঁর স্ত্রী হাবিবা বেগম (২০)। হাবিবা সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ২৭ দিনেও নাসিরের খোঁজ নেই। ওই ট্রলার নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না তাঁর। কিন্তু সংসারে অভাব ছিল বলে যেতে হয়েছে।

নিখোঁজ ট্রলারের মাঝি বেলাল উদ্দিনের (৩৫) বাড়ি শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পেশকারপাড়ায়। সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে তাঁর। টিনশেডের একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রী, মা-বাবাসহ দুই সন্তান নিয়ে বেলালের পরিবার। সাগরে মাছ ধরে চলে টানাপোড়েনের সংসার। তাঁর বাড়িতেও শোকের আবহ। এত দিনেও সন্ধান না পাওয়ায় তাঁর বাবা-মা ও স্ত্রী আতঙ্কে সময় পার করছেন।

স্ত্রী মারুফা জান্নাত বলেন, ‘এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি। গত ২০ সেপ্টেম্বর মুঠোফোনে সর্বশেষ কথা হয়েছিল। তখন তিনি ট্রলার নিয়ে সাগরে যাচ্ছিলেন। এখন তিনি বেঁচে আছেন কি না, জানি না।’

কথার একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মারুফা। জানালেন, এ পর্যন্ত কেউ তাঁদের খোঁজও নেননি।

খুরুশকুলের কাউয়ারপাড়ার মো. খোকনও (২৬) নিখোঁজ জেলেদের একজন। তাঁর মা ধলুবিবি ছেলের জন্য সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছেন। তিনি বলেন, সাত বছর আগে ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন তিনি। সংসারে রয়েছে তিন বছর বয়সী এক মেয়ে। খোকন ফিরে না এলে তাঁদের সব শেষ হয়ে যাবে।

নিখোঁজ জেলে আমির আলী, আজিজুল হক, মো. মিয়া, রুবেল, ছৈয়দ, আবদুল্লাহ, কাশেম, মো. আমিনের পরিবারেরও একই অবস্থা। সবাই অপেক্ষায় আছেন, কখন ফিরবেন তাঁরা। অনন্ত কোনো একটা সংবাদও যদি পেতেন, তাহলেও এত অনিশ্চয়তায় থাকতে হতো না।