হলের তিনতলার বারান্দা থেকে অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে দোতলার ছাদে যান

শহীদ হবিবুর রহমান হলের অনেকে শিক্ষার্থী তৃতীয় তলার বারান্দা হয়ে কৌশলে হলের পশ্চিম পাশে দোতলার ছাদে যাওয়া-আসা করেন বলে জানা গেছে
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী কে জি এম শাহরিয়ার হলের তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে পড়ে মারা গেছেন। তবে বারান্দা থেকে পড়ার প্রত্যক্ষদর্শী কাউকেই পাওয়া যায়নি। শাহরিয়ার শহীদ হবিবুর রহমান হলের ৩৫৪ নম্বর কক্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই হলের শিক্ষার্থীরা বলছেন, হলের অনেকেই তৃতীয় তলার বারান্দা হয়ে হলের পশ্চিম পাশে দোতলার ছাদে যাওয়া-আসা করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ওই হলে গিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

গত বুধবার রাত আটটার দিকে রাবির মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কে জি এম শাহরিয়ার হলের তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে পড়ে যান। এরপর দ্রুত তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে জরুরি বিভাগে তাঁর মৃত্যু হয়।

ইতিহাস বিভাগের ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ফরহাদ শাহরিয়ার অনেকবার দেখেছেন, ওই ছাদে গিয়ে অনেকেই আড্ডা দেন। আবার অনেকেই তৃতীয় তলা থেকে দ্বিতীয় ও প্রথম ব্লকের দিকে যান। তবে তিনি শাহরিয়ারকে কোনো দিন এভাবে পার হতে দেখেননি।

এ ঘটনার পর থেকে বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে আসছে। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ প্রথম দিকে বলেছেন, শাহরিয়ার ছাদ থেকে কিংবা তৃতীয় তলা থেকে লাফ দিতে পারেন। অথবা পা পিছলে পড়ে যেতে পারেন। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, তৃতীয় তলার ওই অংশ দিয়ে নিয়মিতভাবেই হলের পশ্চিম পাশে যাতায়াত করেন শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ দ্বিতীয় ও প্রথম ব্লকেও যান ওই দিক দিয়ে। শিক্ষার্থীদের ধারণা, শাহরিয়ার ওই দিক দিয়ে ছাদে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে থাকতে পারেন। তবে একাধিক শিক্ষার্থী নিয়মিত ওই দিক দিয়ে যাতায়াত করলেও শাহরিয়ারকে কেউ কখনো ওই দিক দিয়ে পার হতে দেখেননি।

গতকাল বিকেলে শহীদ হবিবুর রহমান হলে গিয়ে দেখা যায়, হলের মোট তিনটি ব্লক। শাহরিয়ার তৃতীয় ব্লকের তৃতীয় তলায় থাকতেন। তৃতীয় ব্লকের নিচে পশ্চিম পাশে টিউবওয়েল। এর পাশেই মসজিদ ও ওপরে ওঠার সিঁড়ি। টিউবওয়েলের পাশে যে জায়গায় শাহরিয়ার পড়েছিলেন, সেখানে কাগজ দিয়ে রক্ত ঢেকে রাখা হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় উঠলেই পশ্চিম পাশে দ্বিতীয় তলার ছাদ। ছাদে যাওয়া বন্ধ করার জন্য বারান্দার পশ্চিম দিকে সরাসরি ছাদের অংশে গ্রিল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠলে তৃতীয় তলার প্রথম কক্ষ ৩৩৭ নম্বর। ওই কক্ষে থাকেন ইতিহাস বিভাগের ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ফরহাদ শাহরিয়ার।

নিহত শিক্ষার্থী কে জি এম শাহরিয়ার
ছবি: ফেসবুক থেকে

ফরহাদ বলেন, তিনি অনেক বড় ভাইকে দেখেছেন তৃতীয় তলা থেকে পশ্চিম পাশে দোতলার ছাদে যেতে। এটা হয়তো অনেকেই বিশ্বাসই করবেন না যে এত ঝুঁকি নিয়ে এভাবে ছাদে যায়। তবে তিনি অনেকবার দেখেছেন, ওই ছাদে গিয়ে অনেকেই আড্ডা দেন। আবার অনেকেই তৃতীয় তলা থেকে দ্বিতীয় ও প্রথম ব্লকের দিকে যান। তবে তিনি শাহরিয়ারকে কোনো দিন এভাবে পার হতে দেখেননি।

ফরহাদ আরও বলেন, তাঁরা বিভিন্ন সময় বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কথা বলেন। রেলিংটা কোমরসমান। তাই এ জায়গা দিয়ে কেউ সহজে পড়বেন না, যদি না ওই ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যান।

তৃতীয় তলার বারান্দার এই অংশ দিয়েই শিক্ষার্থীরা পশ্চিম পাশে দোতলার ছাদে যাওয়া-আসা করেন
ছবি: প্রথম আলো

ওই ব্লকের ৩৪৪ নম্বর কক্ষের একই সেশনের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মিলন হাসান বলেন, তিনি বৃষ্টির মধ্যেও অনেককে ওই জায়গা দিয়ে পার হতে দেখেছেন। অন্যদের ছাদে যাওয়ার দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে মিলন বলেন, প্রথমে পশ্চিম দিকের গ্রিলে এক হাত দিয়ে বারান্দার উত্তর-পশ্চিম দিকের রেলিংয়ের ওপর পা রাখতে হয়। পরে পিলারের সঙ্গে বুক ঠেকিয়ে ছাদ অংশে পা বাড়িয়ে ছাদে চলে যাওয়া যায়। এটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনেকেই করতে পারেন বলে তিনি দেখেছেন। তাঁর ধারণা, শাহরিয়ার এভাবে অন্যকে দেখে চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে যেতে পারেন।

তৃতীয় তলার ওই জায়গা দিয়ে একাধিকবার পার হয়েছেন, এমন এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। এই শিক্ষার্থীর উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট। তিনি বলেন, তিনি তাঁর বড় ভাইদের দেখেছেন এভাবে ছাদে যেতে। তাঁরাও লম্বা ছিলেন। এভাবে তিনিও সহজেই পার হতে পারেন। তবে তাঁর হাত ও পা লম্বা বলে সহজেই কাজটি তিনি করতে পারেন। তবে শাহরিয়ার অত লম্বা ছিলেন না।

সাদা কাগজে ঢেকে রাখা ওই স্থানে গত বুধবার রাতে শাহরিয়ারকে পড়ে থাকতে দেখা যায়
ছবি: প্রথম আলো

তৃতীয় তলার ছাদঘেঁষা ওই পিলারে লাল ও সাদা অংশে অনেক হাতের চিহ্ন দেখা গেছে। এতে অনেকটাই স্পষ্ট যে ওই অংশ দিয়ে শিক্ষার্থীরা মাঝেমধ্যেই পার হয়ে থাকেন।

হলের শিক্ষার্থীরা বলছেন, দ্বিতীয় তলার ছাদের পাশ দিয়ে গাছ আছে। ওই গাছগুলো বেয়ে চোর কিংবা মাদকসেবীরা আসতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে ছাদ আটকে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবি, গাছের ডালপালা কেটে এটা উন্মুক্ত করা যেতে পারে। অথবা ছাদে যাওয়ার এই রাস্তা আরও ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে যেন কেউ ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে না পারেন।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে হলের প্রাধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনা আগে জানা ছিল না। বুধবার রাতে দুর্ঘটনার পরই তিনি জানতে পেরেছেন যে শিক্ষার্থীরা ওই অংশ দিয়ে ছাদে যাওয়া–আসা করেন। এ বিষয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবেন।

নগরের মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার আলী তুহিন বলেন, শাহরিয়ারের মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের এক শিক্ষক বাদী হয়ে অপমৃত্যু মামলা করেছেন। এ ঘটনায় তদন্ত চলছে।

আরও পড়ুন