ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি, দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে ১ হাজার ২০০টির বেশি। দ্বীপের মাঝেরপাড়া, কোনারপাড়া, গলাচিপা, দক্ষিণপাড়া, পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়ার অধিকাংশ কাঁচা ঘরবাড়ি মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। এ কারণে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে হাজারো মানুষকে।
দ্বীপের পশ্চিম সৈকতের কাছে সুলতান আহমদের বাড়ির টিনের চাল উড়ে গেছে। উপড়ে পড়েছে ঘরের বেড়াও। ভাঙা ঘরে ভেতরে পাঁচ মেয়ে নিয়ে অবস্থান করছিলেন সুলতানের স্ত্রী হাজেরা বেগম (৬৫)। আজ সকালে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ঘর হারিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। সকাল থেকে চুলা জ্বলেনি। স্বামী সুলতান গেছেন বাজারে চাল-ডাল-তরকারি কিনতে, ততক্ষণে বাড়ি ফেরেননি। হাজেরা বলেন, ‘এহন ঝর (বৃষ্টি) আইলে আঁরা হড়ে (কোথায়) যাইয়্যুই জো (উপায়) ন পাইর। ঘূর্ণিঝর আঁরার ঘরবাড়ি বেগ্গুন শেষ গরি ফেলাইয়ে। আশপাশের বহুত মানুষ খোলা আকাশর নিচত, গাছর নিচত পড়ি আছে, খাইবল্যাই (খাবার জন্য) কিচ্ছু নাই।’
হাজেরা বেগমের বাড়িটি পড়েছে সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিমপাড়ায়। হাজেরার বাড়ির পূর্ব পাশে জেলে ইমাম হোসেন ও জালাল আহমদের ঘরও ভেঙে গেছে। দুজনের বাড়ি ত্রিপলের ছাউনি ও বাঁশের বেড়ায় তৈরি। একটি ঘরে স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতেন ইমাম হোসেন। গতকাল রোববার বিকেলে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারি হলে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পাশের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করেন। ঘূর্ণিঝড় কেটে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখেন, তাঁর বাড়িটি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এর পর থেকে তিনি গাছের নিচে অবস্থান করছেন।
ইমাম হোসেন (৪৫) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, দুই মাস ধরে সাগরে মাছ ধরা পড়েনি। পর্যটক না থাকায় তিন মাস ধরে দ্বীপে কাজও নেই। এখন নতুন করে ঘর তৈরির সামর্থ্য তাঁর নেই। দুই বেলা খাবার জোগাড় দূরের কথা মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
একই কথা বলেন মাঝেরপাড়ার ভ্যানচালক জালাল আহমদ (৪৫)। ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর ত্রিপলের ঝুপড়িঘরটি উড়িয়ে নিয়ে যায়। সেই থেকে পরিবারের চার সদস্য নিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। জালাল আহমদ বলেন, রাতে ঘরে রান্না হয়নি। আজ সোমবার দুপুরেও রান্নার ব্যবস্থা হয়নি। হাটবাজারে মাছ, তরিতরকারির সংকট। হাতে টাকাও নেই। কী খেয়ে ছেলে মেয়েরা বাঁচবে বুঝতে পারছেন না তিনি।
৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নাজির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টি হওয়ায় গৃহহীন পরিবারে দুর্ভোগ নেমে আসছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় কয়েক হাজার মানুষকে রাখা গেলেও সেখানে রান্নাবান্না, গোসল, টয়লেটের ব্যবস্থা নাজুক। গৃহহীন পরিবারে রান্না করা খাবার সরবরাহ করার মতো এনজিও বা সংস্থা সেখানে নেই।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান আজ সকাল ১০টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, সেন্ট মার্টিনের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের তালিকা তৈরি হচ্ছে। এখন বঙ্গোপসাগর উত্তাল আছে, এ কারণে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে জলযান ও ট্রলার চলাচল বন্ধ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিনি আজ বিকেলের দিকে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার প্রস্তুতি নেবেন। তখন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে ত্রাণ ও গৃহনির্মাণসামগ্রী বিতরণ করা যেতে পারে।
সেন্ট মার্টিন ইউপির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বেলা দুইটা থেকে বিকেল সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে দ্বীপের দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ৭০০ কাঁচা ঘরবাড়ি মাটিতে মিশে গেছে। হাজারো মানুষ খোলা আকাশের নিচে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে ত্রাণসহায়তা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, আজ সকাল ছয়টা থেকে তিনি লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নামেন এবং ভেঙে পড়া গাছপালা সরিয়ে সড়ক চলাচলের উপযোগী করছেন। প্রতিটা ওয়ার্ডের সদস্যের নেতৃত্বে গৃহহীন পরিবারের সদস্যদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার পরিবারের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপে প্রায় ৫০০টি নারকেলগাছ ভেঙে গেছে। দ্বীপে নারকেলগাছ ছিল প্রায় ৫ হাজার ৭০০টি।