পুরোদমে চলছে অবৈধ ইটভাটা
মুন্সিগঞ্জে কিছু দিন আগে কয়েকটি অবৈধ ইটভাটাকে জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই সময় ভাটার আংশিক ভেঙে দিয়ে কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশও দেওয়া হয়। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের ওই নির্দেশ উপেক্ষা করে অভিযানের কয়েক দিন পর থেকেই ভাটাগুলোর কার্যক্রম শুরু করেছেন মালিকেরা।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছরই অবৈধ ইটভাটাগুলোতে নামমাত্র অভিযান চালায় পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রশাসনের লোকজন। বন্ধ হয় না ভাটার কার্যক্রম।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মুন্সিগঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় ৫৮টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে শ্রীনগরে দুটি, গজারিয়ায় দুটি ও সিরাজদিখান উপজেলায় ৫৪টি ভাটা রয়েছে। এসব ভাটার মধ্যে ১২টি ভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। এরপরও এগুলো চলছে।
এবার ইট পোড়ানোর মৌসুমে অবৈধ ভাটাগুলোতে দুবার অভিযান পরিচালনা করা হয়। ৩১ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় বেআইনিভাবে ইট পোড়ানো ও আবাসিক এলাকায় ইটভাটা স্থাপনের কারণে সিরাজদিখান উপজেলার বাসাইল ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি ভাটায় অভিযান চালায় প্রশাসন।
এর মধ্যে মেসার্স শামছুদ্দিন অ্যান্ড রবিলা ব্রিকসের মালিক আলতাফ হোসেনকে ৮ লাখ, একই এলাকার মেসার্স ন্যাশনাল ব্রিকসের মালিক অলি আহমেদকে ৭ লাখ টাকা, মেসার্স মা ব্রিকসের মালিক জনি আহমেদকে ৭ লাখ টাকা এবং বালুচর ইউনিয়নের মায়ের দোয়া ব্রিকসের মালিককে ১০ লাখ টাকাসহ মোট ৩২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি আরও একটি অভিযানে একই উপজেলার খাজা ব্রিকসকে ৫ লাখ, সাজিদ ব্রিকসকে ৫ লাখ ও স্টার গ্রিন ব্রিকসকে ৩ লাখ ৫০ হাজার জরিমানা করা হয়। সেই সঙ্গে ভাটার কার্যক্রম বন্ধ করতে নির্দেশনা দিয়ে ভাটার বিভিন্ন স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
ইট পোড়ানোর ধুম
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিযানের দুদিন পর থেকেই অবৈধ ইটভাটাগুলোর কার্যক্রম আবার শুরু করা হয়। গত বুধবার বেলা ১১টার দিকে বালুচর ইউনিয়নের রামকৃষ্ণদি এলাকার সাজিদ ব্রিকসে গিয়ে দেখা যায়, কাঁচা ইট রোদে শুকাচ্ছেন ভাটার শ্রমিকেরা। অভিযানে চুল্লির নামমাত্র ভাঙা অংশ মেরামত করে ভাটার কার্যক্রম চলছে। শ্রমিকেরা চুল্লিতে কয়লা দিচ্ছেন। আগের পোড়ানো ইট ট্রাকে করে ভাটা থেকে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রেতারা। এ সময় ভাটাটির কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, অভিযানে চুল্লির কিছু অংশ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। দুদিন পর থেকে ভাটার মালিকের নির্দেশে চুল্লি মেরামত করে কাজ চলছে।
জরিমানা ও নিষেধাজ্ঞার পরও ইটভাটার কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে সাজিদ ব্রিকস কোম্পানির মালিক হাজি মোহাম্মদ শাহ আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে শ্রমিক এনেছি। এখন ইটভাটা বন্ধ করে দিলে সব টাকায় লোকসান গুনতে হবে। তাই ভাটার কাজ চলমান রেখেছি।’
প্রশাসনের অভিযানের ভেঙে দেওয়া গ্রিন ব্রিকসের ভাটায়ও দেখা গেল, ইট প্রস্তুত থেকে বিক্রি সব কাজ পুরোদমে চলছে। এ ভাটার পাশেই একটি গ্রাম ও মাদ্রাসা রয়েছে। এ ভাটায় দুটি নিচু চিমনি দিয়ে অনবরত কালো ধোঁয়া বের হয়ে লোকালয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। যে ১২টি ভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই, এর মধ্যে এ ভাটাটিও রয়েছে।
গ্রিন ব্রিকসের ব্যবস্থাপক বশির উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এ দেশে টাকা হলে শুধু ইটভাটা নয়, সবই চালানো যায়। আমাদের জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স আছে। পরিবেশের ছাড়পত্র নেই, এ দোহাই দিয়ে জরিমানা করছে। ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করতে ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ করেছি। শুনেছি, অনেকেই ১৩-১৪ লাখ টাকা খরচ করে ছাড়পত্র এনেছে। আমরাও চেষ্টা করছি।’
এ ছাড়া খাজা ব্রিকস, ন্যাশনাল ব্রিকসেরও কার্যক্রম চলছে। তবে প্রশাসনের অভিযানের নামে ইটভাটার মালিকদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে দাবি করেন মুন্সিগঞ্জ ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান। তিনি জানান, এ বছর ইট তৈরিতে মালিকপক্ষের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, তাই মালিকদের ভাটা না চালিয়েও উপায় নেই। মান্নান বলেন, ‘যাঁরা ইকো সিরামিক কারখানা চালাচ্ছে, তাঁরাও কয়লা জ্বালায়। ইট বানাতে কৃষিজমির মাটি ব্যবহার করে। তাদের বেলায় আইন নেই, আমাদের সাধারণ ইটভাটার মালিকদের বেলায় উল্টো চিত্র।’
বিষয়টি নজরে আনা হলে মুন্সিগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান জানান, ‘অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অভিযান চলমান থাকবে। অভিযানের পরেও যাঁরা ইটভাটা চালাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মুন্সিগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ইটভাটা সিরাজদিখানে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ উপজেলার স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ইটভাটার কারণে ব্যাপকভাবে ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। একরের পর একর জমির উপরিভাগের মাটি কেটে পুকুর বানানো হচ্ছে। সেই মাটি ট্রাকে করে সড়ক দিয়ে পরিবহনের সময় সড়ক ও বাড়িঘর নষ্ট হচ্ছে। ভাটার চিমনির ধোঁয়ায় পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। গাছপালায় ফুল-ফল ধরা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফসলের আবাদ কমেছে। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তর, উপজেলা প্রশাসন প্রতিবছর নামমাত্র দু–একটা অভিযান পরিচালনা করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করে দেয়।