শরৎচন্দ্র থেকে উদয়শঙ্কর, কে আসেননি গুঁড়িয়ে দেওয়া বাড়িটিতে
কানাডাপ্রবাসী রীনা চক্রবর্তী রাজশাহীতে এসে ছুটে গিয়েছিলেন মামা ঋত্বিক ঘটকের বাড়িতে। ৬২ বছর আগে বাড়িটি ছেড়ে যাওয়ার সময় চোখ না-ফোঁটা ছয়টি বিড়ালের বাচ্চা রেখে গিয়েছিলেন। এত বছর পরও তাঁর মনে হলো, ‘গিয়ে দেখি, বাচ্চাগুলোর চোখ ফুটেছে কি না!’
মনে হলো মাঝখানের বছরগুলো যেন উড়ে গেছে। তিনি সেই খুকিটিই রয়ে গেছেন। দেড় দশক আগে ২০০৯ সালে রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটির আয়োজনে ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিতে এসে তিনি এ অনুভূতির কথা বলেছিলেন।
ঋত্বিকের এই বাড়ির সৌজন্যে বহু বরেণ্য ব্যক্তি রাজশাহী চিনেছেন। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক একবার ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমা দেখার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সেই সিনেমা দেখার মুগ্ধতা বুকের মধ্যে মধুর মতো জমে আছে।’
ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিধন্য রাজশাহীর বাড়িটি আর নেই, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়িটিই এখন যেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’ হয়ে গেল। আর দেখা যাবে না। তবে বাড়ির স্মৃতিটা ঋত্বিকপ্রেমীদের বুকের মধ্যে মধুর মতোই জমে থাকবে।
ঋত্বিক ঘটক ও তাঁর বোন প্রতীতি দেবী যমজ ছিলেন। ‘ঋত্বিককে শেষ ভালোবাসা’ নামে স্মৃতিকথার বই আছে তাঁর। বইয়ে বাড়িটির স্মৃতিচারণায় প্রতীতি দেবী লিখেছেন, ‘বাবা অবসর নেওয়ার পরে রাজশাহীতে এসে বসবাস শুরু করলেন। আমাদের বিশাল বাড়ি। কাছেই সাগরপাড়ায় থাকতেন আমার মাতামহ, নামকরা অ্যাডভোকেট শ্রী মহেশ্বর ভট্টাচার্য, ব্রজেন্দ্র মৈত্র পাকিস্তানের সংসদ সদস্য, সুরেশ মৈত্ররা ছিলেন আমার মায়ের পিসতুতো ভাই। অখণ্ড ভারতের সংসদ সদস্য কিশোরী মোহন চৌধুরী ছিলেন আমার মাসতুতো ভাই।’
কারা এই বাড়িতে এসেছেন, সেই প্রসঙ্গে প্রতীতি দেবী লিখেছেন, ‘আমরা যখন রাজশাহীতে, তখন সেখানকার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল অত্যন্ত উঁচুমানের। পুঠিয়ার রাজা, নাটোরের মহারাজা, দীঘাপতিয়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিবছর শীতে সাহিত্য-সংগীত সম্মেলন হতো। এসব সম্মেলনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন আমার বড় ভাই মনীশ ঘটক। এই সূত্রে আমাদের রাজশাহীর বাড়িতে পদার্পণ ঘটেছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ কুমার সান্যাল, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখের। শরৎচন্দ্রের কথা আমার মনে আছে। তিনি চা-কফি ছাড়া কিছু খেতেন না। এত শান্ত আর কথা কম বলতেন যে আমি একবার দাদাকে বলি, এই তোমাদের শরৎচন্দ্র? ইনি তো কথাই বলেন না।’
প্রতীতি দেবীর লেখায় আরও অনেক বরেণ্য ব্যক্তির তাঁদের রাজশাহীর বাড়িতে আসার কথা উল্লেখ আছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমার বড় দাদার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ মুজতবা আলী। শেষোক্ত জনের বড় ভাই আইসিএস এস এম আলী ছিলেন আমার বাবার বিশিষ্ট বন্ধু। সে সময় রাজশাহীতে হিন্দু-মুসলমানের কোনো বিভেদ ছিল না। সাম্প্রদায়িক শব্দটাই কখনো শুনিনি। আমাদের বাড়িতে মুসলমান সম্প্রদায়ের জ্ঞানী-গুণীরা তো আসতেনই। সাধারণ শ্রেণিরও ছিল অবাধ প্রবেশ। হিন্দু ছেলেদের পাশাপাশি বহু মুসলমান ছেলে আমাদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছে। শিল্পী জয়নুল আবেদিনও আমাদের বাড়িতে থেকেছেন। সংগীত সম্মেলনে যোগ দিতে ১৯৩৫ সালে এসেছিলেন ফয়েজ খাঁ, আব্দুল করিম খাঁ, ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, তারাপদ ঠাকুর, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। তাঁরা আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে আসেন। উদয় শঙ্করও এসেছেন। তাঁর সঙ্গে ঋত্বিকের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে ঋত্বিক উদয় শঙ্করের কলকাতার বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেছে।’
যমজ ভাইয়ের স্মৃতি মনে করে প্রতীতি দেবী লিখেছেন, ‘আমাদের রাজশাহীর বাড়ির বিশাল ছাদের ওপরে আমরা দুই ভাইবোন ঘুড়ি ওড়াতাম। বাড়ির কাজের লোকেরা কাচ গুঁড়ো করে সুতোয় মাঞ্জা দিত। আমাদের ঘুড়িটা হঠাৎ কেটে যায়। সেটির সুতো ধরতে গিয়ে আমি ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার ডান হাত ও পা দুই টুকরো হয়ে গেল। কিন্তু ঋত্বিকের ‘মা, মা’ করে বুকফাটা কান্না শুনে সবাই ওকে নিয়েই টানাটানি করছে। সবাই ভাবছে ঋত্বিকের কিছু হয়েছে। আর আমি? ওই ভাঙা হাত ব্যান্ডেজ করে আবার ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গেছি। দুপুর হলেই ঋত্বিক আর আমি ছাদে চলে যেতাম। আমার কণ্ঠে ওর প্রিয় গান ছিল “মধ্য দিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি/ হে রাখাল, বেনু তবে বাজাও একাকী।”’
প্রতীতি দেবী বলেন, ‘৫০ সালে আমার বিয়ে আর ওর (ঋত্বিক ঘটক) বিএ পাস একত্রে হলো। ও কলকাতায় রয়ে গেল। ও জীবনে দুটো জিনিস কখনো মেনে নিতে পারেনি। এক দেশ ভাগ, দুই আমার বিয়ে। বিয়ে আমাদের জন্য অভিশাপ মনে করতাম। পরে ঋত্বিক ঘটকই হয়ে ওঠেন কালজয়ী চলচ্চিত্রকার ও পরিচালক। ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে হোমিও কলেজের নামে ইজারা দেওয়া হয়েছিল।’
জানা গেছে, কলেজ কর্তৃপক্ষ পরে প্রতিষ্ঠানের নামে খারিজ করে নিয়েছে। সেখানে ভবন নির্মাণ করেছেন। বাড়িটার একাংশ রাজশাহীর সংস্কৃতিকর্মীদের দাবির মুখে শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল। ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। খবর পেয়ে গত বুধবার দুপুরে জড়ো হন রাজশাহীর চলচ্চিত্রকর্মীরা। এ সময় কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চলচ্চিত্রকর্মীদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে ঠিকাদারের দাবি।
চলচ্চিত্রকর্মীরা বলছেন, ৬ আগস্ট দুপুর ১২টা ৪৪ মিনিট পর্যন্ত কলেজের সিসিটিভি চলছিল। এর পর থেকে সিসিটিভি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোনো ফুটেজ ধারণ হয়নি। তাঁদের অভিযোগ, এই ভাঙচুরে কলেজ প্রশাসনের হাত আছে। তবে কলেজের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেন, ‘এর আগেও সিসিটিভি বন্ধ হয়ে গেছে। এটা নতুন কিছু না। এটা আমরা বন্ধ করিনি।’
ঋত্বিক ঘটকের এই বাড়িকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করে রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটি। ২০০৯ সালে সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের ভাগনি (মেজ বোন সম্প্রীতি দেবীর মেয়ে) কানাডাপ্রবাসী রীনা চক্রবর্তী ও আরেক বোন প্রতীতি দেবীর মেয়ে আরমা দত্ত। বাড়িতে থেকেছেন ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী।
তখন রীনা চক্রবর্তী প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেছিলেন, বাড়ির সামনের প্রাচীরের খানিকটা এখনো আছে। ছোটবেলায় যাদের সঙ্গে ঝগড়া করতেন, আড়ি দিতেন—সব ওই প্রাচীরের পাশে দাঁড়িয়ে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তিনি এই বাড়িতে ছিলেন। প্রাচীরের পাশে অনেক মানুষ দাঁড়িয়েছিল। পাশেই ব্যানার্জি বাড়িতে রেডিও ছিল। রেডিওতে ঘোষণা হলো, রাজশাহী পাকিস্তান। সঙ্গে সঙ্গে অনেক মানুষ লাফিয়ে উঠল। হাততালি দিতে লাগল। তিনিও তাঁদের সঙ্গেই হাততালি দিলেন। কিন্তু বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখেন সবার মুখ গোমড়া। এর তিন দিন পরই তাঁরা রাজশাহী ছেড়ে চলে যান। তিনিও স্মৃতি হিসেবে প্রাচীর থেকে একটি ইটের টুকরা তাঁর ব্যাগে ভরে নেন।
চলচ্চিত্র উৎসবের অনুষ্ঠানে তিনবার এসেছিলেন ঋত্বিক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রের প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান, অভিনেতা নায়ক প্রবীর মিত্রসহ বহু বরেণ্য ব্যক্তি। এসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে হোমিও কলেজের মিলনায়তনটি ঋত্বিক ঘটকের নামে করার দাবি ওঠে। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক একটি ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছিলেন। সেটি ওভাবেই রয়ে গেছে। বাড়ির পুরোনো অংশের দুই কক্ষের ভবনটির একটি কলেজের বহির্বিভাগ ও একটি গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন সেসব শুধুই স্মৃতি।
ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি এফ এম এ জাহিদ বলছেন, তাঁর বাড়িও ভাঙচুর করা হয়েছে। কিন্তু ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ভাঙায় তিনি বেশি কষ্ট পেয়েছেন। এখন ভিটে সংরক্ষণের দাবি নিয়ে প্রশাসনের কাছে ছোটাছুটি করছেন।
শুক্রবার সকালে নগরের মিঞাপাড়ায় বাড়ির কাছে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা বাড়ির ইট স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। শুধু মনে হতে লাগল সেই গান, ‘মধ্য দিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি/ হে রাখাল, বেনু তবে বাজাও একাকী’।