‘আকাশে মেঘ দেখলিই বুকির মধ্যি দুড়ুম দুড়ুম করে’

দীর্ঘদিন বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতায় দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হচ্ছে খুলনার তিন উপজেলার মানুষের। সুপেয় পানি নিতে হয় জলাবদ্ধতার পানি মাড়িয়ে। রংপুর, ডুমুরিয়া উপজেলা, খুলনা, ১৬ অক্টোবরছবি: সাদ্দাম হোসেন

‘ঘরের মধ্যি প্রায় হাঁটুসমান জল। পুকুর, ঘের-ভেড়ি সব ডুবি গেছে। ঘরের মধ্যি ইট দি (দিয়ে) উঁচু করি চুলো পাতিছি। তাতেই কোনো রকম রান্না করি খাতিছি। বাথরুম জলে তলায় গেছে। এ কারণে রাস্তার পাশে কোনো রকম একটা বাথরুম তৈরি করি নেওয়া হয়িছে। প্রায় দুই মাস ধরি এইভাবে কষ্ট করতিছি। এখন আকাশে মেঘ দেখলিই বুকির মধ্যি শুধু দুড়ুম দুড়ুম করে।’

কথাগুলো বলছিলেন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া ইউনিয়নের পাটকেল পোতা গ্রামের উত্তরা বিশ্বাস। খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের গুটুদিয়া সেতুর ঠিক পাশ দিয়ে উত্তর দিকে চলে গেছে একটি সড়ক। সেটি স্থানীয় লোকজনের কাছে ওয়াপদা সড়ক নামে পরিচিত। পিচঢালা সড়ক ধরে কিছুদূর গেলেই পড়ে উত্তরা বিশ্বাসদের গ্রাম। পিচের সড়কের পাশেই তাঁর বাড়ি। সড়ক ও বাড়ির মাঝখানে রয়েছে শুধু একটি পুকুর।

পানিতে তলিয়ে থাকায় পুকুরের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না। চারপাশে উঁচু করে নেট দেওয়া। এ কারণেই কিছুটা অনুমান করা যায় সেটি পুকুর। পাকা একতলা বাড়ির মেঝের ওপরেও পানি ছলাৎ ছলাৎ করছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটির তৈরি গোয়ালঘর ও রান্নাঘর। তিনি বলেন, ‘জল ওঠার পর থেকি দুই দিন রান্না করতি পারিনি। তখন চিড়া, মুড়ি খাইয়ি থাকতি হয়িছে। পরে অন্য এক বাড়ি থেকি রান্না করি নিয়ে আসতাম। তিনটি গরু ছিল, তা অন্যের বাড়ি রাখি আইছি। দুটো ছাগল ছিল, রাখার জায়গা না থাকায় তা বিক্রি করি দিতে হইছে।’

এবারের অতিবৃষ্টিতে ডুমুরিয়া উপজেলার অর্ধেকের বেশি গ্রাম তলিয়ে গেছে। পানিনিষ্কাশনের জন্য তৈরি করা জলকপাটগুলো (স্লুইচগেট) নষ্ট থাকায় পানি সরতে পারছে না। এতে জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব অঞ্চলের মানুষ। হাজার হাজার বিঘা ঘের ও ফসলের খেত পানিতে তলিয়ে আছে। তলিয়ে গেছে আমন ধানের খেতও। জলাবদ্ধতায় মানুষের মধ্যে রোগবালাই বাড়ছে। গাছপালা পচে পানি দূর্ষিত হয়ে পড়েছে। এতে চর্ম ও পেটের রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দিয়েছে। তাই তো আকাশে সামান্য মেঘ দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে উঠছেন উত্তরা বিশ্বাসের মতো ডুমুরিয়া উপজেলার হাজার হাজার মানুষ।

পিচঢালা সড়ক থেকে উত্তরা বিশ্বাসের বাড়ি যেতে ছোট একটি ইটের সড়ক রয়েছে। সেটি চলে গেছে গ্রামের মধ্যে। ইটের সড়কটি পুরোটাই পানিতে তলানো। পাশের যে দু–চারটি বাড়ি দেখা যায়, তা–ও পানিতে তলিয়ে গেছে।

ওই সড়ক ধরে বেশ সতর্কতার সঙ্গে ধীরে ধীরে পিচের সড়কের দিকে আসছিলেন ষাটোর্ধ্ব কালিদাশ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘গত ২০ বছরের মধ্যি এমন অবস্থা দেখিনি। আগে জল উঠলিও দু-এক দিনের মধ্যি তা নামি য্যাতু। এবার দেড় মাসেরও বেশি সময় হয়ি গেল অথচ জল নামতিছে না। একটু বৃষ্টি হলি হড়হড় করি জল বাড়তিছে। আমরা যে কত কষ্টে আছি, তা শুধু আমরাই বুঝতি পারতিছি।’

ধসে পড়া ঘরে কোনোমতে থাকার চেষ্টা। রংপুর, ডুমুরিয়া উপজেলা, খুলনা, ১৬ অক্টোবর
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

সম্প্রতি ডুমুরিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে জলাবদ্ধ মানুষের দুর্ভোগের নানান চিত্র দেখা গেছে। কোনো কোনো এলাকায় চলাচলের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে নৌকা। জলাবদ্ধতার কারণে মানুষ হয়ে পড়েছে ঘরবন্দী। কাজ না থাকায় কষ্টে দিন পার করছেন তাঁরা।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, খুলনার ৯টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় ডুমুরিয়া উপজেলা। ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত উপজেলাটি। আর গ্রামের সংখ্যা ২৩৭টি। অতিবৃষ্টিতে উপজেলার প্রায় সব কটি ইউনিয়নেই কমবেশি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা রয়েছে গুটুদিয়া, রংপুর, খর্ণিয়া, রঘুনাথপুর, ধামালিয়া, আটলিয়া ও মাগুরাঘোনা ইউনিয়নে। এসব ইউনিয়নের ১০০টির বেশি গ্রাম এখন পানিতে তলিয়ে আছে। দুর্বিষহ জীবন পার করছেন এসব গ্রামের মানুষ। থাকার জায়গা নেই, রান্না করার জায়গা নেই, নেই শৌচকর্ম করার মতো কোনো স্থান। মানুষের পুকুর, মাছের ঘের ও ফসলের খেত—সবই তলিয়ে আছে। কত দিনে এমন দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ পাবেন, তা–ও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।  

গুটুদিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী সুব্রত কুমার ফৌজদার বলেন, তাঁদের এলাকায় এবার পূজার কোনো আনন্দ হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, পানি কমছে না। বৃষ্টি না হওয়ায় এক সপ্তাহের মধ্যে দুই ইঞ্চির মতো পানি কমেছে; কিন্তু গত দুই দিনে যে বৃষ্টি হয়েছে, তাতে পানি আরও বেড়েছে।

ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আল-আমিন চিকিৎসাজনিত ছুটিতে আছেন। ওই উপজেলার ইউএনও হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন ফুলতলার ইউএনও তাসনীম জাহান। তিনি বলেন, এ বছর অনেক বৃষ্টি হয়েছে। পানিনিষ্কাশনের নদী ও খাল ভরাট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে আছে জলকপাটগুলোও। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ওই উপজেলার ইউএনও আল-আমিন বেশ চেষ্টা করছেন। যন্ত্রের সাহায্যে নদী ও খাল খনন এবং জলকপাটগুলো সংস্কারের মাধ্যমে পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা করেছে। অন্যদিকে পাম্প করেও পানি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। বৃষ্টি না হলে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই পানি কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।