আজ বিশ্ব ডাক দিবস
হৃদয়ছোঁয়া লেখা চিঠির চালাচালি আর হয় না
চার দশক আগেও নানা প্রয়োজনে মানুষ চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করতেন। কিন্তু এখন মানুষ মুঠোফোন দিয়ে যোগাযোগের কাজটি সেরে নিচ্ছেন।
মা-বাবাসহ বড়দের লুকিয়ে চিঠি লিখে রঙিন খামে ভরে পছন্দের মানুষটির কাছে পাঠানো হতো চিঠি। তাতে থাকত গভীর আবেগ ও হৃদয়ছোঁয়া লেখা। রেকর্ড করা ক্যাসেটের ফিতা ও উপহারের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা, ডাকপিয়নের হাঁকডাক শুনে বাড়ির দুয়ারে ছুটে যাওয়া এবং ‘বাই এয়ার মেইল’ লেখা খাম পেয়ে খুশিতে বকশিশ তুলে দেওয়া। এরপর রাত জেগে চিঠি পড়া অথবা ক্যাসেটের ফিতায় ধারণ করা প্রিয়জনের কথা শুনতে শুনতে উত্তেজনায় ভোর হয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো এখন অতীত।
বিশ্ব ডাক দিবসের প্রসঙ্গ তুলতেই চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার কুলচাড়া এলাকার বাসিন্দা কবি রিচার্ড রহমান এক নিশ্বাসে এভাবেই চিঠি বিনিময়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে এসব কথা বলেন। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই নয় , মা-বাবাসহ ছোট ভাইবোনের কাছে চিঠি লেখার রেওয়াজও ছিল একটি সময় পর্যন্ত।
চিঠি লিখে খামে ভরার সময় বোনের খামে প্রেমিকার চিঠি এবং প্রেমিকার খামে বোনের চিঠি ভরে পাঠিয়ে ধরা খাওয়ার ঘটনাও অনেকের জীবনে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। ডাকঘর, পোস্টমাস্টার ও ডাকপিয়ন সবই আছে। চিঠিপত্রও চালাচালি হয়। শুধু নেই সেই চিঠি, যে চিঠির জন্য অপেক্ষার প্রহর ছিল দীর্ঘ।
আজ ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক দিবস। ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিওতে বিশ্ব ডাক সংস্থার সম্মেলনে দিবসটি পালনের প্রস্তাব করা হয়। ওই বছরের ৯ অক্টোবর থেকে বিশ্ব ডাক দিবস পালন করা হচ্ছে। একটা সময় ছিল, যখন চিঠি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিল ডাক বিভাগ।
ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল—এমনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ডাকঘরের কদর ছিল। কিন্তু নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের হাতে হাতে মুঠোফোন চলে আসায় এখন চিঠি-চালাচালি কমে গেছে। এখন ডাক বিভাগে চিঠি-চালাচালির চেয়ে বৈদেশিক ডাকসেবা, এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস (ইএমএস), গ্যারান্টেড এক্সপ্রেস পোস্ট (জিইপি), ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিসসহ (ইএমটিএস) নতুন নতুন সেবা যুক্ত হয়েছে। তবে সঞ্চয়পত্র, ডাক জীবন বিমা, মানি অর্ডার ও পোস্টাল অর্ডার সেবা এখনো বহাল।
গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গার প্রধান ডাকঘরের অবস্থানকালে অন্তত ২০ জন গ্রাহকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। যাঁদের মধ্যে ১৮ জনই এসেছিলেন আর্থিক লেনদেনের বিষয় নিয়ে। বাকি দুজন এসেছিলেন গ্যারান্টেড এক্সপ্রেস পোস্ট (জিইপি) সার্ভিসের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ নথি পাঠাতে। জান্নাতুল ফেরদৌস নামের একজন গ্রাহক জানান, ছেলে চট্টগ্রামে লেখাপড়া করেন, তাঁর কাছে ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিসে (ইএমটিএস) টাকা পাঠাতে এসেছেন। গ্রাহক আবদুর রহমান জানান, ডাক জীবন বিমার বিষয়ে খোঁজ নিতে এসেছেন।
লোকবল-সংকটে সেবায় হিমশিম
ডাক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চুয়াডাঙ্গার প্রধান ডাকঘর ছাড়াও এই ডাকঘরের অধীন আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা ও জীবননগরে উপজেলা ডাকঘর, দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা, আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ বাজার ও চুয়াডাঙ্গা শহরে কালেক্টরেট ভবনে তিনটি উপডাকঘর (সাবপোস্ট অফিস) এবং ৬০টি শাখা ডাকঘর রয়েছে। কিন্তু প্রধান ডাকঘরসহ ডাকঘরের প্রতিটি শাখায় জনবল-সংকট রয়েছে। যে কারণে গ্রাহকদের সেবা দিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হিমশিম অবস্থা।
প্রধান ডাকঘরের পরিদর্শক মো. আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে জানান, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকাসহ পাশে আলুকদিয়া, মোমিনপুর, পদ্মবিলা ও শংকরচন্দ্র ইউনিয়নের একাংশে চিঠিপত্র ও অন্যান্য নথিপত্র সরবরাহের জন্য ছয়জন ডাকপিয়ন কর্মরত ছিলেন। অতি জরুরি এই ডাকপিয়নের ছয়টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। ধার করা দুজনকে দিয়ে কোনোরকমে কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যার মধ্যে আলমডাঙ্গা উপজেলা ডাকঘর থেকে প্রেষণে আনা হয়েছে হাসান আলীকে। এ ছাড়া এই ডাকঘরের একজন ডাকপিয়ন কাজী লিটনের পদোন্নতি হলেও স্থানীয়ভাবে সেবার ধারাবাহিকতা রাখতে তাঁকে প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত রাখা হয়েছে।
এই কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক জেলার সীমানার সঙ্গে ডাক বিভাগের জেলা সীমানার কিছুটা পার্থক্য আছে। তিনি বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গা জেলার চার উপজেলা ছাড়াও ঝিনাইদহ সদর ও মহেশপুর উপজেলার ১০টি এবং মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার দুটি শাখা ডাকঘর চুয়াডাঙ্গা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রতিটি শাখায় পাঁচজন করে জনবল থাকার কথা থাকলেও বেশির ভাগ শাখায় দুজন এবং হাতে গোনা কয়েকটিতে তিনজন করে কর্মরত আছেন।’
চিঠি পড়ে না ডাকবাক্সে
সরেজমিনে চুয়াডাঙ্গা প্রধান ডাকঘরের সামনে উত্তর-পশ্চিম ফটকের পাশে চরম অবহেলায় একটি ডাকবাক্স দেখতে পাওয়া যায়। আশপাশের দোকানদারেরা জানান, দুই বছর ধরে ওই ডাকবাক্সে কেউ চিঠি ফেলেন না। তাই ডাকবাক্সটিও আর খোলা হয় না। প্রধান ডাকঘরের কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
চুয়াডাঙ্গার সদ্যবিদায়ী পোস্টমাস্টার মো. আবদুল মমিন বলেন, ১৯৯০ সালে প্রধান ডাকঘরে সে সময় চিঠি, পার্সেলসহ প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২৫টি খাম চুয়াডাঙ্গা থেকে বাইরে পাঠানো হতো। প্রায় সমপরিমাণ বাইরের জেলা থেকে আসত। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ ব্যক্তিগত চিঠি ছিল। বর্তমানে প্রতিদিন ২২৫ থেকে ২৫০টি ডকুমেন্ট চুয়াডাঙ্গা থেকে পাঠানো হয় এবং প্রায় সমপরিমাণ আসে।