বাউ মিষ্টি আলু-৫ উদ্ভাবন গবেষণা শুরু হয় কবে?
আরিফ হাসান: ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এই গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। উচ্চ ফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষককে সাহায্য করার আকাঙ্ক্ষা থেকে এই গবেষণা। কনসোর্টিয়াম অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ সেন্টারসের (সিজিআইএআর) আওতাভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল পটেটো সেন্টারের (সিআইপি) আর্থিক সহযোগিতায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
লাভজনক উৎপাদনে মাটি ও আবহাওয়া পরিস্থিতি কেমন হওয়া উচিত?
আরিফ হাসান: মিষ্টি আলু চাষের জন্য সাধারণত বেলে, বেলে দো-আঁশ মাটি বেশি উপযোগী। এ কারণেই চর এলাকায় এটি বেশি চাষ হয়। তাপমাত্রা ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে গাছের বাহ্যিক বা দৈহিক গঠন ভালো হয়। অন্যদিকে ফলন বৃদ্ধি বা আলুর সঠিক বৃদ্ধির জন্য আরও কম তাপমাত্রা প্রয়োজন, যা ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে অতিরিক্ত শীত (১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে) অথবা অতিরিক্ত গরম (৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে) আবহাওয়ায় গাছের বৃদ্ধি ও ফলন উভয়ই ব্যাহত হয়।
দেশে প্রচলিত মিষ্টি আলুর জাতগুলো থেকে বাউ মিষ্টি আলু-৫–এর উৎপাদন কতটা বেশি?
আরিফ হাসান: উপযুক্ত ও অনুকূল পরিবেশে বাউ মিষ্টি আলু-৫–এর উৎপাদন প্রতি হেক্টরে সর্বোচ্চ ৪০ টন হওয়া সম্ভব। তবে রোগ সংক্রমণ, ইঁদুরের উৎপাতসহ কিছু প্রতিকূলতা থেকেই যায়। এমন অবস্থায় সর্বোচ্চ উৎপাদন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৩৩ টন পাওয়া গেছে। দেশে প্রচলিত মিষ্টি আলুর জাতীয় গড় উৎপাদন ১০ টনের মতো। সে হিসাবে এই আলুর উৎপাদন তিন গুণের বেশি। প্রচলিত জাতগুলোতে আলু পরিপক্ব হতে সময় লাগে প্রায় ১৫০ দিন। উদ্ভাবিত নতুন জাতটিতে ৯০ দিনে একটি গাছ থেকে প্রায় ১ কেজি মিষ্টি আলু পাওয়া সম্ভব, যা ১১০ থেকে ১২০ দিনে প্রায় দেড় কেজিতে পৌঁছায়।
বছরের কোন সময় এই জাতের আলুর চারা রোপণ ও আলু উত্তোলন করতে হয়?
আরিফ হাসান: বাউ মিষ্টি আলু-৫ কম-বেশি প্রায় সারা বছরই চাষ করা যায়। তবে রবি মৌসুমে (১৬ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ) এর ফলন ভালো হয়। এই জাতের চারা রোপণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো সময় হলো নভেম্বরের শেষের সময়টা। মার্চের শেষের দিকে এই মিষ্টি আলু উত্তোলন করলে ফলন সবচেয়ে ভালো পাওয়া যায়।
উদ্ভাবিত নতুন জাতটির পুষ্টিগুণ কেমন?
আরিফ হাসান: প্রতি ১০০ গ্রাম বাউ মিষ্টি আলু-৫-এ শর্করার পরিমাণ ১৯ থেকে ২৩ গ্রাম, যা ভাতের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। এতে খাদ্যশক্তি পাওয়া যায় প্রায় ৮৬ কিলোক্যালরি। ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ৩৮ মিলিগ্রাম, যা ভাতের তুলনায় ৩ থেকে ৪ গুণ। এর লৌহ উপাদান মায়েদের জন্য খুবই উপকারী। ভিটামিন ‘এ’–এর পরিমাণ ৫ থেকে ৯ মিলিগ্রাম। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার শিশু ভিটামিন ‘এ’–এর অভাবে রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়। প্রতিদিন প্রায় ১২৫ গ্রাম মিষ্টি আলু খেলে শিশুদের রাতকানা রোগ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘এ’–এর চাহিদা মেটানো সম্ভব। শুধু তা–ই নয়, এই মিষ্টি আলুর পাতা ও ডগা শাক হিসেবেও খাওয়া যায়, যা ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’–এর ভালো উৎস। প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টি আলুতে আঁশজাতীয় উপাদান থাকে ৩ গ্রাম, যা আমাদের হজমপ্রক্রিয়ায় সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এর গ্লাইসেমিক সূচক কম, যা রক্তের শর্করার মাত্রার ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলে না বলে ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জন্যও উপকারী। এ ছাড়া এই মিষ্টি আলু আমিষ, জিংক, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, ভিটামিন ‘ই’, ভিটামিন ‘কে’ ও পটাশিয়ামের জোগান দিতে সক্ষম।
ক্ষতিকর পোকা বা রোগবালাই সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু? প্রতিকারের উপায় কী?
আরিফ হাসান: বাউ মিষ্টি আলু-৫–এ সাধারণত মাঠের রোগবালাইয়ের সংক্রমণ খুবই কম। তবে উইভিল নামের একটি পোকার আক্রমণ দেখা যায়, যা ফলন অনেক কমিয়ে দিতে পারে। ভাইরাস সংক্রমণ থেকে গাছকে বাঁচাতে সুস্থ গাছের লতা থেকে চারা উৎপাদন করতে হবে। উইভিল পোকা আক্রান্ত গাছ এবং আলু পুড়িয়ে ফেলতে হবে, যাতে অন্যান্য গাছে নতুন পোকার জন্ম হতে না পারে।
এই মিষ্টি আলু চাষে কৃষক কীভাবে লাভবান হবেন?
আরিফ হাসান: বাউ মিষ্টি আলু-৫ একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ফসল। ফলে কৃষক তাড়াতাড়ি ফসল ঘরে তুলতে পারেন। পরবর্তী সময়ে নতুন ফসলের জন্য ওই জমি ব্যবহার করতে পারেন। সাধারণ জাতের তুলনায় এই জাতের উৎপাদন তিন গুণের বেশি। ফলে কৃষক বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারেন।
মিষ্টি আলু সংরক্ষণ ও দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে কীভাবে এটি যুক্ত করা যায়?
আরিফ হাসান: এই জাতের মিষ্টি আলুর সংরক্ষণে আর্দ্রতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সংরক্ষণের জায়গাটি কম আর্দ্রতাসম্পন্ন, শুষ্ক ও উঁচু হতে হবে। আমাদের দেশে সাধারণত সেদ্ধ করে বা পুড়িয়ে মিষ্টি আলু খাওয়া হয়। তবে পায়েস, বিভিন্ন পিঠা ও ফিরনিতেও মিষ্টি আলু ব্যবহার করা যায়। বাচ্চাদের মিষ্টি আলুর প্রতি আকৃষ্ট করার ভালো একটি উপায় হলো মিষ্টি আলুর পিৎজা বানিয়ে দেওয়া।
বর্তমানে কোথায় কোথায় এই জাত চাষ করা হচ্ছে?
আরিফ হাসান: বর্তমানে শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল ও খুলনায় বাউ মিষ্টি আলু-৫–এর চারা সরবরাহ করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলার কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে ওই উপজেলায় চারা সরবরাহ করা হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ের কৃষকদের কাছে উদ্ভাবিত এই জাত পৌঁছে যাচ্ছে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমেও এই বাউ মিষ্টি আলু-৫–এর চারা সরবরাহ করার পরিকল্পনা আছে।