হাসছে শাখায় শাখায় চোখজুড়ানো রক্তকাঞ্চন

ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে রক্তকাঞ্চনের গাছ। ছড়াচ্ছে সৌন্দর্য। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ঘড়ুয়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজারের প্রবীণ সাংস্কৃতিক সংগঠক সৈয়দ আবদুল মোত্তালিব ওরফে রঞ্জু গত বছরই জানিয়েছিলেন, তাঁর এক আত্মীয়বাড়িতে একটি ফুলের গাছ আছে। ফাগুন মাসে লাল রঙের ফুলে ফুলে গাছটি ভরে যায়। পাতার চেয়ে ফুলই বেশি। গাছটির পরিচয় তাঁর জানা নেই। সেবার আর গাছটি দেখতে যাওয়া হয়নি।

এবারও গাছটিতে অনেক ফুল এসেছে। গত শুক্রবার হঠাৎ করেই জানালেন, সেই বাড়িতে তিনি (রঞ্জু) যাবেন। ফুল ভালোবাসেন, ফুলের গাছ লাগান এবং সেসব গাছের পরিচর্যা করেন, এমন কিছু মানুষও তাঁর সঙ্গে সেখানে যাবেন। ওইদিনই বিকেলে সবাই একত্রিত হয়ে সেই ফুলগাছ দেখতে রওনা দিলেন।

ফুলপ্রেমীদের মধ্যে ছিলেন কানাডাপ্রবাসী নুরুর রহমান; যিনি মৌলভীবাজার শহরকে ফুলে ফুলে সাজিয়ে তুলতে বছরের একটা বড় সময় দেশে থাকেন। মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমান, চিকিৎসক এম এ আহাদসহ ফুলপ্রেমী অন্যদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ফুলের চর্চা করে বেড়ান। সড়কের পাশে, বাসাবাড়িতে ফুলের গাছ লাগাতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। বিনা মূল্যে বিভিন্ন জাতের ফুল গাছের চারা বিতরণ করেন।

ফুল গাছ দেখতে যাওয়া এই দলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক এবং সাহিত্যের ছোটকাগজ ফসল সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল খালিক, ব্যাংকার ও অনুবাদক আশরাফ আলম। আর পথপ্রদর্শক সৈয়দ আবদুল মোত্তালিব রঞ্জু তো ছিলেনই।

বাড়িটি মৌলভীবাজার শহর থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরের গ্রাম ঘড়ুয়ায়। ঘড়ুয়া গ্রাম হলেও প্রায় শহরের মতোই। একটি আঁকাবাঁকা পথ ধরে গাড়িটি যখন সেই বাড়ির কাছাকাছি, তখনই একটি পুকুরপাড়কে রঙিন করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটি সবার নজর কাড়ে। গাছটির আশপাশে আর কোনো গাছ নেই। বিকেলের রোদে একলা নিভৃত-নির্জনে দাঁড়িয়ে আছে গাছটি। শাখা-প্রশাখাজুড়ে ফুল আর ফুল। কাছাকাছি হলে গাছটি আরও নজরকাড়া হয়ে ওঠে। গাছজুড়ে লাল রঙের ফুলের হাসি। ফুলের ফাঁকে ফাঁকে কিছু পাতা আছে। পাকা পুকুরঘাটের উত্তর পাশে জলের দিকে ঝুলে থাকা গাছটি ফুল ফুটিয়েই যেন খুশি। জলের বুকে ভাসছে ঝরা পাপড়ি-দল।

এটি একটি রক্তকাঞ্চন ফুলের গাছ। গাছটি বেশ পুরোনো। বিভিন্ন সময় ডালপালা কাটা-ছাঁটা হয়েছে। আবার ছড়িয়ে গেছে ডালপালা। গোড়ার দিকে বুনো লতাপাতা জড়ানো। বাড়িতে লোকজনের তেমন ভিড় নেই। ফুল ফোটে, আবার নিঃশব্দ নীরবেই ঝরে যায়। যে বাড়ির আঙিনায় ফুলের গাছ, সে বাড়ির অন্যতম মালিক মসুদ আহমদ জানালেন, প্রায় ২৫ বছর আগে এই গাছের চারা পুকুরপাড়ে লাগানো হয়েছিল। গাছটি অনেক বড় হয়ে ওঠে। এই গাছ থেকে চারা করে বাড়িতে আরও কিছু গাছ লাগানো হয়েছে। বাড়ির একটি দালানসংলগ্ন স্থানে আরও একটি বড় রক্তকাঞ্চনের গাছ দেখা গেছে। তাতেও কয়েকটি থোকায় ফুল ফুটেছে।

মসুদ আহমদ মৌলভীবাজার শহরে থাকেন। তবে প্রায়ই দিনের বড় একটা সময় বাড়িতে এসে কাটান। বাড়ির এক পাশে প্রাচীরঘেরা স্থানে বিভিন্ন জাতের আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, আমড়া, জলপাই, ড্রাগন, দারুচিনি, নারকেল, সুপারিসহ অনেক জাতের ফল-ফসলের গাছ লাগিয়েছেন। সেগুলোর যত্ন-পরিচর্যা করেন। এটা তাঁর ভালো লাগার, আনন্দের একটি জায়গা।

রক্তকাঞ্চনের গাছটিতে পাতার চেয়ে ফুলই বেশি। গাছজুড়ে লাল রঙের ফুলের হাসি। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ঘড়ুয়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

প্রাবন্ধিক ও ফসল সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল খালিক জানিয়েছেন, তিনি দুই-তিন বছর আগে তাঁর গ্রামের বাড়িতে আরও কিছু ফুলের সঙ্গে রক্তকাঞ্চনের একটি গাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছটিতেও এবার অনেক ফুল এসেছে। রক্তরঙে সেজে উঠেছে গাছটি।

কাঞ্চন ফুলের কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে রক্তকাঞ্চন একটি। গাছ ছোট আকারের, কাণ্ড খাটো, কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখা বেশ শক্ত এবং ছড়ানো। তবে মাঝেমধ্যে বড় আকৃতির গাছও চোখে পড়ে। এটি পত্রঝরা বৃক্ষ। শীতে গাছের সব পাতা ঝরে যায়। ফুল ফোটার সময়টাতে গাছে পাতা থাকে না। এ সময়ে রক্তিম ফুলে গাছ ভরে যায়। নজরকাড়া হয়ে ওঠে গাছ। ফুল মূলত ঘন টকটকে লাল রঙের। বিস্তৃত শাখা-প্রশাখার অগ্রভাগে এক বা একাধিক ফুল ফোটে। শীতের শেষ দিক থেকে শুরু হয়ে পুরো গ্রীষ্মকালেই ফুল ফোটে। তবে মৌসুমের শুরুতেই বেশি ফুল ফোটে। ফুল শেষে গাছে শিমের মতো চ্যাপটা ফল হয়। রং প্রথমে সবুজ। পরিপক্ব হলে কালচে রং ধারণ করে। শুকিয়ে একসময় আপনাআপনিই ফেটে বীজগুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। গাছ বেশ কষ্টসহিষ্ণু। বীজ ও ডাল কাটিংয়ের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা যায়। রক্তকাঞ্চনের নানা রকম ভেষজ গুণও আছে। উঁচু ভূমি, রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ থেকে হালকা ছায়াযুক্ত স্থান ও প্রায় সব ধরনের মাটিতে এ ফুল গাছ জন্মে।

মৌলভীবাজারে রক্তকাঞ্চন খুব বেশি গাছ দেখা যায় না। বিক্ষিপ্তভাবে হঠাৎ করে একটি–দুটি গাছের দেখা মেলে। মৌলভীবাজার-শমসেরনগর সড়কের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সীমানাপ্রচীর ছুঁয়ে দাঁড়ানো একটি গাছে এবার প্রচুর রক্তকাঞ্চন ফুল ফুটেছে। এ ছাড়া মৌলভীবাজার সরকারি কলেজেও একটি বড় রক্তকাঞ্চনের গাছ আছে। রক্তকাঞ্চনে সড়ক, ঘরবাড়ি ও শহরকে সাজিয়ে তোলার সুযোগ আছে। রক্তকাঞ্চন মন রাঙাতে কাছের প্রতিবেশী হয়ে উঠতেই পারে।