‘বন্যাত তো আমরারে বড় কষ্ট দেয়’
‘সব সমস্যা তো গরিব মানুষের। কামকাজ নাই, হাত খালি। কিলা ছলতাম, কিলা খাইতাম। বন্যা তো আমরারে বড় কষ্ট দেয়।’ সুনামগঞ্জে চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন সদর উপজেলার কালীপুরের বাসিন্দা শামসুদ্দিন। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বারবার বন্যা দেখা দেওয়ায় শামসুদ্দিনের মতো বিপাকে পড়েছেন জেলাটির অসংখ্য পানিবন্দী বাসিন্দা। এদিকে জেলাটিতে বারবার বন্যার আঘাত হানার পেছনে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রমকে দায়ী করেছেন পরিবেশবাদী নেতারা।
স্থানীয় বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব শামসুদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী রাবেয়া খাতুন বলেন, প্রথম দফার বন্যায় বসতঘরে পানি ঢোকার পর কালীপুর গ্রামে একটি নির্মাণাধীন ভবনে পরিবারের সবাই আশ্রয় নেন। পরিবারের নয়জন সদস্য ও ছয়টি গরু নিয়ে সেখানে বেশ কয়েক দিন কাটান। মাঝে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও আবার শুরু হয় টানা বৃষ্টি; আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল তো আছেই। এতে আবার দেখা দেয় বন্যা। এ কারণে বাধ্য হয়ে সেখানেই আছেন তাঁরা। কিন্তু কোনো কাজে যেতে না পারায় সামনের দিনগুলোয় কীভাবে চলবেন, কী খাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই শামসুদ্দিন ও রাবেয়ার।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কালীপুর গ্রামটির প্রধান সড়কে ২২ দিন ধরে পানিতে তলিয়ে আছে। পানি না নামায় বাসিন্দারা ভোগান্তি নিয়ে চলাফেরা করছেন। এ এলাকার বেশির ভাগ মানুষের ঘরেই বন্যার পানি ছিল। কিছু কিছু ঘর থেকে পানি নামলেও এখনো প্লাবিত আছে কয়েকটি। কালীপুরের পাশে হাসনবসত, ওয়েজখালী এলাকার ঝাওয়ার হাওরপারের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট থেকে আজ সকাল পর্যন্ত পানি নামেনি।
স্থানীয় বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘গ্রামের দক্ষিণ পাশে শ্বশুরবাড়িত গিয়া উঠছিলাম। এখনো উঠানও পানি, রাস্তাত পানি। পানি তো এক জায়গায় আটকি আছে। যাইত চার না।’
পাশের ইসলামপুর গ্রামের বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, গ্রামটির সড়কে কোমরসমান পানি আছে। নৌকা নিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে গ্রামের মানুষদের। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে।
সুনামগঞ্জে ও এর উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত তিন দিন তুলনামূলক কম বৃষ্টি হয়েছে। একই সময় উজান থেকে পাহাড়ি ঢলও নেমেছে কম। তাই সুরমা নদীর পানি কমলেও হাওর এলাকায় পানি স্থির আছে। বৃষ্টি হলে হাওরে ও নদীতে পানি বাড়ে।
সুনামগঞ্জের ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের নেতারা মনে করছেন, হাওর ও নদীর পানি চলাচলের পথ বন্ধ হওয়ার কারণে মৌসুমের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতে প্রতিবছর বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এ বছর সুরমা নদীর তীরের নবীনগর থেকে ব্রাহ্মণগাঁও পর্যন্ত সড়কের নয়টি স্থান ভেঙে হাওরে পানি ঢুকেছে। অথচ মাত্র দুই মাস আগে নির্মিত হয়েছিল সড়কটি। নদীর পানি হাওরে ঢোকার পথ না থাকায় সড়কটি ভেঙেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হাওরে নদীর পানি প্রবেশের পথ থাকলে সড়কের ক্ষতি হতো না।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নদী থেকে হাওরের সঙ্গে যুক্ত খালগুলো দখলে-দূষণে অস্তিত্ব হারিয়েছে। যে কয়েকটি টিকে আছে, সেগুলোও সংকুচিত হয়ে পানি ধারণের ক্ষমতা কমেছে। হাওরে অপরিকল্পিতভাবে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কারণেও পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই সংকট দূর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে।‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’–এর সহসভাপতি সুখেন্দু সেন
সংগঠনের সহসভাপতি সুখেন্দু সেন বলেন, সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নদী থেকে হাওরের সঙ্গে যুক্ত খালগুলো দখলে-দূষণে অস্তিত্ব হারিয়েছে। যে কয়েকটি টিকে আছে, সেগুলোও সংকুচিত হয়ে পানি ধারণের ক্ষমতা কমেছে। হাওরে অপরিকল্পিতভাবে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কারণেও পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই সংকট দূর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, আজ শনিবার সকাল ছয়টায় সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ৬৬ মিটার, যা বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার নিচে আছে। তবে জেলার ছাতক উপজেলায় এখনো সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপরে আছে।
জেলায় আবার ভারী বৃষ্টি না হলে আর কোনো সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার। তিনি বলেন, নদী ও হাওরে পানি ধীরে ধীরে কমছে। বৃষ্টি হলে পানি আবার কিছুটা বাড়তে পারে। তবে বন্যা পরিস্থিতির খুব বেশি অবনতি হবে না।