রাজশাহীর প্রত্যন্ত গ্রামে মোটরসাইকেলের ৪০ শোরুম, রমরমা ব্যবসা

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুরিয়া ইউনিয়নের মাহেন্দ্রা বাজারে গড়ে উঠেছে নতুন পুরাতন মোটরসাইকেল বিক্রির শো-রুমছবি: প্রথম আলো

বাজারটি খুব বড় নয়। ভেতর দিয়ে একটি সরু রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার ধারে থাকা দোকানগুলোতে বড় বড় সাইনবোর্ড। সেখানে বেশির ভাগ সাইনবোর্ডে লেখা, এখানে নতুন-পুরোনো মোটরসাইকেল বেচাকেনা চলে। সঙ্গে ফোন নম্বর ও একাধিক মোটরসাইকেলের ছবি। কারও শোরুম থাই গ্লাস দিয়ে ঘেরা। কোনোটিতে শুধুই শাটার লাগানো। এ রকম প্রায় ৪০টি মোটরসাইকেলের শোরুম আছে বাজারটিতে। ছোট এই বাজারে এসব শোরুমে মাসে অন্তত ৫০০ থেকে ৭০০টি মোটরসাইকেল বেচাকেনা চলে। এতে মাসে পাঁচ থেকে সাত কোটি টাকার লেনদেন হয়।

এই বাজারের অবস্থান রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুরিয়া ইউনিয়নের মাহেন্দ্রা বাজারে। বাজারটিতে অন্য সব দোকানের ভিড়ে মোটরসাইকেল শোরুমের সংখ্যা বাড়ছে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে এসে মোটরসাইকেল বেচাকেনা করে থাকেন। এতে ওই বাজারের অন্য সব জিনিসের বেচাবিক্রিও বেড়েছে। মোটরসাইকেলের নানা অনুষঙ্গের দোকানও বেড়েছে।

শুরুটা যেভাবে

২০০৩ সালে গ্রামের যুবক আরিফ মাহমুদের বাবা মারা যান। তাঁর এক আত্মীয় তখন দু-একটি মোটরসাইকেল কেনাবেচা করতেন। তখন থেকেই মোটরসাইকেলের প্রতি টান তাঁর। চালানো শিখেন। মোটরসাইকেল কেনাবেচার ব্যবসাতেও জড়িয়ে যান। বাড়ির একটি ঘরে লিখে ফেলেন ‘এখানে মোটরসাইকেল কেনাবেচা চলে’। ২০০৫ সালে আরিফ এক মেয়েকে পছন্দ করেন। মেয়েটিও তাঁকে পছন্দ করেন। কিন্তু ছেলে কিছু করেন না, এই কথা বলে অভিভাবকেরা বিয়ে দিতে চাইছিলেন না। ওই বছরই তিনি ফায়সাল আহম্মেদ নামের আরেকজনকে নিয়ে মোটরসাইকেলের শোরুম দেন মাহেন্দ্রা বাজারে। প্রত্যন্ত গ্রামে মোটরসাইকেলের শোরুম দেখে লোকে হাসাহাসি করতেন। হাল ছাড়েন না তাঁরা। প্রথম মাসেই মোটরসাইকেল বিক্রি করে ১৭ হাজার টাকা লাভ হয় তাঁদের। আড়াই বছর পর দুজন আলাদা করে মোটরসাইকেলের শোরুম দেন বাজারে।

আরিফ বলেন, বাড়িতে মোটরসাইকেল ব্যবসা করার সময় একবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন, কিন্তু ব্যবসা ছাড়েননি। এখনো ব্যবসা ছাড়তে পারেননি। আরও বহু তরুণ-যুবক বাজারটিতে ব্যবসা করছেন। কারও ব্যবসা সে অর্থে কম হয় না। ব্যবসা বেড়েই চলেছে।

সরেজমিন একদিন

রাজশাহী শহর থেকে ১২ কিলোমিটার পূর্বে মাহেন্দ্রা বাজার। রাজশাহী শহর থেকে কাটাখালী পৌরসভা হয়ে পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়ন হয়েও আসা যায়। আবার নগরের নওদাপাড়া আমচত্বর হয়ে সরাসরি বাইপাস রাস্তা ধরেও আসা যায়। সম্প্রতি এক বিকেলে বাজারটিতে এই প্রতিবেদক যান। বাজারটিতে বড় কোনো পাকা ভবনও নেই। ওপরে টিন আর ইট-সুরকি দিয়ে দেয়াল তৈরি ঘর। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সেখানে পৌঁছে দেখা যায়, অন্তত ৩০টি মোটরসাইকেলের শোরুম খোলা আছে।

বাজারের ভেতরে দিয়ে পবা উপজেলা থেকে একটি রাস্তা পুঠিয়ার মাহেন্দ্রা বাজার হয়ে দুর্গাপুর উপজেলার দিকে গেছে। রাস্তাটি মাহেন্দ্রা বাজারের ওপর দিয়ে গেছে। এই রাস্তার ধারে হওয়া দোকানগুলোতেই মোটরসাইকেলের শোরুম। প্রতিটি দোকানে দু-তিনজন করে কর্মচারী রাখা আছে। তাঁরা ক্রেতাকে মোটরসাইকেল দেখিয়ে থাকেন। সাধারণত দুপুর পর থেকে রাত পর্যন্ত বেচাকেনা চলে। শুক্রবার ও শনিবার সারা দিন বেচাকেনা চলে। মোটরসাইকেল বেচাকেনার এই বাজারে মোটরসাইকেল সারানোর জন্য একাধিক মেকানিকও দোকান বসিয়েছেন। তাঁরাও ভালো ব্যবসা করছেন।

মেসার্স আবরার এন্টারপ্রাইজ নামের শোরুমে একটি ঘরের মধ্যে ২০ থেকে ৩০টি মোটরসাইকেল সাজিয়ে রাখা। শোরুমের ভেতরে বসেছিলেন মালিক মো. সোহেল রানা। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে পড়েছেন। তাঁর কাছে তখন একজন ক্রেতা মোটরসাইকেল কেনার জন্য এসেছেন। তিনি কথা বলছিলেন সেই ক্রেতার সঙ্গে। দর–কষাকষি শেষে ১ লাখ ৩ হাজার ৫০০ টাকায় একটি মোটরসাইকেল কিনে নিলেন দুর্গাপুর উপজেলার আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, ছেলে সিঙ্গাপুরে থাকে। তাঁর (মান্নান) চলাচলে অসুবিধা হয়। এই কথা বলার পর ছেলে মাহেন্দ্রা বাজারে পাঠিয়েছেন। ছেলেকে মোটরসাইকেল ভিডিও কলে দেখালেন। তাঁরও পছন্দ হয়েছে, ছেলেরও। পরে কিনে নিলেন। এই বাজারে যতগুলো শোরুম আছে, কোনো বড় শহরেও এতগুলো নেই। এখান থেকে দেখেশুনে মোটরসাইকেল কেনা যায় বলেই এসেছেন।

‘মামা-ভাগিনা বাইক পয়েন্ট’ নামে চার মাস আগে নতুন শোরুম দিয়েছেন মো. রাকিবুল ইসলাম নামের এক তরুণ। তিনি ওই বাজারে চার বছর ধরে হার্ডওয়্যারের দোকান চালান। রাকিবুল বলেন, ভাগিনা বেকার। একটি শোরুম নিয়ে তাঁকে দোকানে বসিয়ে দিয়েছেন। এতে ভাগিনারও কর্ম হলো, তাঁরও ব্যবসা ভালোই হচ্ছে। তবে এই বাজারে এখন দোকানভাড়া বেড়ে গেছে। প্রত্যন্ত গ্রামের দোকানগুলোতেও তিন-চার লাখ টাকার মতো সিকিউরিটি চার্জ দিতে হয়।

এত শোরুম যে কারণে

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পুরোনো মোটরসাইকেল বিক্রির জন্য একসঙ্গে এতগুলো শোরুম রাজশাহীতে আর কোথাও নেই। এখানে বেশির ভাগ শোরুমে পুরোনো গাড়ি বিক্রি করে থাকে। এখানে এসে দেখেশুনে তাঁরা কিনতে পারেন। দামও অনেক কম। এ ছাড়া নতুন গাড়ির দাম ও রেজিস্ট্রেশন খরচ বেশি। পুরোনো গাড়ির বেশির ভাগই রেজিস্ট্রেশন করা থাকে। সে জন্য কেউ অল্প টাকায় মোটরসাইকেল কেনার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন। এই জায়গায় মোটরসাইকেলের অনেক শোরুম আছে, এই খবর রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এ জন্য এখানে ক্রেতার ভিড় থাকে।

মাহেন্দ্রা বাজারের কয়েকজন উদ্যোক্তা বলেন, পুঠিয়া, দুর্গাপুরসহ কয়েকটি উপজেলায় প্রচুর পান ব্যবসায়ী আছেন। কয়েক বছর ধরে এই এলাকার মানুষ মাছ চাষেও সফল হয়েছেন। তাঁদের হাতে প্রচুর টাকা থাকে। একজনের দেখাদেখি আরেকজন এসে মোটরসাইকেল কিনে নিয়ে যান। কিস্তিতে, আবার বাকিতেও মোটরসাইকেল কেনা যায় এখান থেকে।

কথা হয় মাহেন্দ্রা বাজার বণিক সমিতির সভাপতি মো. সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, কয়েকজন তরুণের কারণেই বাজারটি আজ জমজমাট। এ রকম গ্রামের মধ্যে প্রতিদিনই অচেনা বহু মানুষ আসেন। ধীরে ধীরে বাজারটির পরিচিতি বাড়ছে। মোটরসাইকেলের শোরুমও বাড়ছে। বাজারের নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। এখানে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। এ কারণে বাজারজুড়ে তাঁরা সিসিটিভি ক্যামেরা বসাবেন। এ ছাড়া এখানে একটি ব্যাংকের শাখার জন্যও আবেদন করবেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ‘প্রত্যন্ত গ্রামে এ ধরনের উদ্যোগ বিরল ঘটনা। অর্থনীতিতে আমরা জানি যে এ ধরনের ট্রেড সেন্টার গঠনে যে ধরনের উপাদানগুলো আমরা প্রচলিতভাবে চিন্তা করি, তার হয়তো কিছুই নেই। এখানে মোটরসাইকেল উৎপাদিত হয় না, কিন্তু কীভাবে এই ক্রয়-বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে উঠল, তার বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। এখানে কোনো ধরনের ব্যাংকিং সুযোগ-সুবিধা নেই, যোগাযোগব্যবস্থাও তেমন নেই, তারপরও উদ্যোক্তারা ধীরে ধীরে সফল হচ্ছেন এবং ধীরে ধীরে উদ্যোক্তা বাড়ছে।’