ফণীন্দ্র লালের টাটকা গরম রসগোল্লা আর শিরায় ভেজা পাউরুটি

চট্টগ্রামের বাঁশখালীল বাণীগ্রামে ফণীন্দ্র লালের মিষ্টির দোকানে রসগোল্লা খেতে দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই আসেনছবি : প্রথম আলো

বাটিতে ধোঁয়া ওঠা টাটকা গরম রসগোল্লা। সঙ্গে পরিবেশন করা হয়েছে স্লাইস করা পাউরুটি। বাটির শিরায় ডুবিয়ে প্রথমেই পাউরুটির টুকরা একটু ভিজিয়ে নিতে হবে। তারপর রসে সিক্ত পাউরুটির সঙ্গে চামচে করে মুখে চালান করতে হবে অর্ধেকটা রসগোল্লা। লোকে বলে, ফণীন্দ্র লালের মিষ্টি খাওয়ার রেওয়াজই এমন। তুলতুলে স্পঞ্জের মতো গরম এই রসগোল্লা আর পাউরুটি মুহূর্তেই যে স্বাদের অনুভূতি তৈরি করে, তা এককথায় অনন্য। চোখ বন্ধ হয়ে আসে তৃপ্তিতে।

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নের বৈলগাঁও এলাকার বাণীগ্রাম বাজারের ফণীন্দ্র লাল দের মিষ্টির দোকানটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোকজনের কাছে ফণীবাবুর মিষ্টির দোকান নামে পরিচিত। চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক এলাকায় রসগোল্লাকে মিষ্টিই বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে লোকে। তাই ফণীবাবুর রসগোল্লাকেও লোকে মিষ্টিই বলে। এই মিষ্টির সুনাম আশপাশের উপজেলায়ও ছড়িয়েছে। দীর্ঘ ৫৭ বছর ধরে একই কায়দায় রসগোল্লা তৈরি হচ্ছে এই দোকানে।

বাণীগ্রাম বাজারে ফণীবাবুর মিষ্টি খেতে গিয়ে ঢুকতে হলো ভিড় ঠেলে। ছোট দোকান, মানুষের ভিড়ে গমগম করছে। বাইরেও অনেকে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ অটোরিকশা থামিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন নিজের কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা দাঁড় করিয়ে মিষ্টি কিনছিলেন জহিরুল আলম (৫৩)। কথা বলে জানা গেল, নিয়মিতই এই দোকানে আসেন তিনি। বোনের বাড়িতে ফণীবাবুর মিষ্টি নেবেন বলে দাঁড়িয়েছেন। জহিরুল জানালেন, এখানকার টাটকা গরম রসগোল্লা, নিমকি, জিলাপি খুব ভালো। শুধু এলাকার লোকজন নয়, দূর–দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন এই দোকানের মিষ্টি কিনতে।

বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নকে শিক্ষা-সংস্কৃতির পীঠস্থান বলা চলে। ইউনিয়নের বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চবিদ্যালয়টিও শতবর্ষী। আশপাশে যাতায়াতব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় ওই বিদ্যালয়ের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে আনোয়ারা ও সাতকানিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের শিক্ষার্থীরা। বিদ্যালয়টির কারণেই জমজমাট হয়ে ওঠে বাণীগ্রাম বাজার। আর এই বাজারেই ১৯৬৮ সালে মিষ্টির দোকান দেন ফণীন্দ্র লাল দে। তিনি স্থানীয়ভাবে দুধ সংগ্রহ করে মিষ্টি, জিলাপি, নিমকি, সন্দেশ ও অমৃতি তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীল বাণীগ্রামে ফণীন্দ্র লালের মিষ্টির দোকানে রসগোল্লা খেতে দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন
ছবি : প্রথম আলো

বাণীগ্রাম বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ফণীন্দ্র লাল দের মিষ্টির দোকান চালু হওয়ার পর এর সুনাম দক্ষিণ চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। আর এ কারণে বিয়েশাদিসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে এই দোকানের মিষ্টি অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

জানা গেল, দোকান শুরুর ২৪ বছর পর ১৯৯২ সালে মারা যান ফণীন্দ্র লাল দে। এরপর তাঁর ছেলে পীযূষ কান্তি দে দোকানের হাল ধরেন। কিন্তু তিনিও বেশি দিন ওই দোকান চালাননি। ১৯৯৮ সালের দিকে দোকানের কারিগর মিলন দের হাতে মালিকানা তুলে দিয়ে দোকান ছেড়ে দেন পীযূষ কান্তি। এরপর গত ২৬ বছর দোকান চালিয়ে আসছেন মিলন দে। তবে মালিকানা বদল হলেও মিষ্টির গুণগত মান কমেনি।

জানতে চাইলে মিলন দে বলেন, ‘আমি ১৯৯০ সালে দোকানে চাকরি নিই। এর দুই বছর পর মারা যান মালিক ফণীন্দ্র লাল দে। এরপর তাঁর ছেলে পীযূষ কান্তি দোকানের দেখভাল শুরু করেন। পরে তিনিও মারা গেলে ১৯৯৮ সাল থেকে আমি দোকানের হাল ধরি। মাসিক ভিত্তিতে দোকান ভাড়ার টাকা ফণীন্দ্র লাল দের পরিবারের হাতে তুলে দিই আমি।’

ফণীদ্র লালের দোকানের নিমকি
ছবি: প্রথম আলো

ফণীন্দ্র লাল দে তাঁর জীবদ্দশায় কারিগর মিলনকে তাঁর দোকানের নাম ও মান ধরে রাখার অনুরোধ করেছিলেন। সেই কথা রাখতে গিয়ে মিলন দে ফণীবাবুর নামটি দোকানের ফলকে রেখে দিয়েছেন। চেষ্টা করেছেন মিষ্টির গুণগত মান ধরে রাখতে। আর এই কারণেই তাঁর দোকানের মিষ্টির এমন কদর।

ফণীবাবুর মিষ্টির দোকানে দৈনিক গড়ে এক মণ মিষ্টি বিক্রি হয় বলে জানালেন এর বর্তমান মালিক মিলন দে। সপ্তাহের সব দিনই মিষ্টির বেচাকেনা ভালো। তবে শুক্রবার বিক্রি হয় বেশি। মিষ্টির দোকানের আয় থেকেই মিলন দে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন। বর্তমানে তাঁর ছেলে কৃষি ডিপ্লোমা কোর্সে, এক মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক ও আরেকজন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে।

চাহিদা রয়েছে গরম গরম জিলাপিরও
ছবি: প্রথম আলো

দোকানে বর্তমানে ২৫০ টাকায় প্রতি কেজি মিষ্টি ও ১৬০ টাকায় জিলাপি বিক্রি হয়। এ ছাড়া নিমকিরও চাহিদা রয়েছে। লোকজন বাসায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দোকানে বসে মিষ্টি খেয়ে যান বলে জানালেন কারিগর মিল্টন চৌধুরী।

স্থানীয় গোয়ালা কাঞ্চন দাশ (৫০) ৩২ বছর ধরে এ দোকানে দুধ সরবরাহ করছেন। তিনি বলেন, ‘এত বছর ধরে ফণীবাবুর দোকানে দুধ দিচ্ছি। নিয়মিত মিষ্টিও খাচ্ছি। এক দিনের জন্যও মিষ্টির স্বাদ ও গন্ধ এদিক-ওদিক হতে দেখিনি।’

দোকানের পেছনেই মিষ্টি তৈরির কারখানা। সেখানে মিল্টন চৌধুরীসহ চারজন কারিগর ছানা কেটে মিষ্টি তৈরি করেন। এক পাশের চুলায় গরম শিরায় মিষ্টি তৈরি হচ্ছে। পাশের কড়াইয়ে ভাজা হচ্ছে জিলাপি আর নিমকি। ছানা আর চিনির শিরার কড়া ঘ্রাণে ডুবে আছে ছোট ঘরটি। মিষ্টি তৈরি হতেই চলে যাচ্ছে কাউন্টারের সামনের বড় গামলায়। আর শেষও হচ্ছে দ্রুত। ফণীবাবুর মিষ্টি বলেই কথা। মিষ্টি গরম থাকতেই বেচা হয়ে যায়।