কক্সবাজারে সিন্ডিকেটের ফাঁদে লবণের বাজার, দাম বাড়লেও অখুশি চাষিরা
কক্সবাজার উপকূলে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে হঠাৎ লবণের দাম কমতে থাকে। তখন ৫০০ টাকা দরের প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছিল ২৫০ টাকায়। এভাবে টানা দুই সপ্তাহ চলার পর ৮ মার্চ থেকে লবণের দাম আবার ঊর্ধ্বমুখী। এখন মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ থেকে ৩৮০ টাকায়।
লবণ উৎপাদন ও বেচাবিক্রি নিয়ে আজ শুক্রবার অন্তত ৪০ জন চাষি, ব্যবসায়ী ও মিলমালিকদের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। চাষিদের অভিযোগ, উৎপাদনের ভরা মৌসুমে মিলমালিকেরা সিন্ডিকেট করে লবণের দাম কমবেশি করছেন। মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম আরও ২০ থেকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৪৩০ টাকা রাখার দাবি জানিয়ে তাঁরা বলেন, এটা করা হলে ৪৫ হাজার প্রান্তিক চাষি আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি থেকে রেহাই পাবেন।
বর্তমানে ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকায় লবণ বিক্রি করেও লাভের মুখ দেখছেন না বলে উল্লেখ করেন চাষিরা। তাঁদের ভাষ্য, প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ২১০ টাকার বেশি। এর সঙ্গে জমির ইজারা, শ্রমিক ও পরিবহন খরচ রয়েছে।
শাহপরীর দ্বীপের লবণচাষি জাফর আলম (৫২) প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ দিন আগেও তিনি প্রতি মণ লবণ ২৬০ টাকায় বিক্রি করেছেন। এখন দাম প্রতি মণে ১১০ টাকা বেড়েছে। গতকাল ৩৬০ টাকা দামে ৫৭ মণ লবণ বিক্রি করেন তিনি। মাঠে মজুত রয়েছে আরও ৫৫ মণ। লবণের দাম ৪০০ টাকার বেশি পাওয়া না গেলে লাভ হবে না।
মিলমালিকদের কারসাজিতে লবণের দাম ওঠানামা করে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ লবণচাষি সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি আনোয়ার পাশা চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চাষিদের লাভ লুটে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। দ্রুত সময়ের মধ্যে মণপ্রতি লবণের দাম ৪৫০ টাকার বেশি নির্ধারণ করা না হলে মাঠে নামবেন চাষিরা।
কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক নিজেও একজন লবণচাষি। লবণের ব্যবসা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ রেখে মাঠপর্যায়ে চাষিদের সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় লবণ বেচাবিক্রির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে ৫০০ টাকায় লবণ বিক্রিও হয়েছে। এরপর সিন্ডিকেট চক্র দাম কমিয়ে চাষিদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি শুরু করেছে। এখন মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম মৌসুমজুড়ে ৪০০ টাকার বেশি দাবি চাষিদের।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ মাস) কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু ও বাঁশখালী উপজেলার ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। ৮ মার্চ পর্যন্ত সাড়ে ৩ মাসে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ১০ লাখ ৫২ হাজার ৩২১ মেট্রিক টন, যা গত মৌসুমের এ সময়ের তুলনায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন বেশি। গত বছর এই সময়ে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ৭ লাখ ২২ হাজার মেট্রিক টন।
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের তথ্যমতে, প্রায় ৪৫ হাজার প্রান্তিক চাষি ও ১ লাখ শ্রমিকসহ জেলার অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বিসিকের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, পলিথিন প্রযুক্তিতে জেলায় দৈনিক ১৭ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। এর বাজারমূল্য দাঁড়ায় ১৫৩ কোটি টাকা।
মাঠে উৎপাদিত ৯০ শতাংশ লবণ বেচাবিক্রি হয় কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামপুরে। সেখানে লবণ মিল আছে ৬৯টি। ইসলামপুর লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আজ তাঁরা এক বস্তা (দুই মণ) লবণ কিনেছেন ৮৪০ টাকায়। সে ক্ষেত্রে প্রতি মণ লবণের দাম পড়ছে ৪২০ টাকা। কিন্তু মাঠপর্যায়ের চাষিরা প্রতি মণ লবণের দাম পাচ্ছেন সর্বোচ্চ ৩৮০ টাকা। মধ্যের ৪০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। এসব তদারকির কেউ নেই।
কুতুবদিয়ার লেমশিখালী ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। বিক্রিও ভালো। ব্যবসায়ীরা মাঠের লবণ কিনে শ্রমিকদের মাধ্যমে কার্গো ট্রলার বোঝাই করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় পাঠাচ্ছেন। চাষিদের অভিযোগ, এখন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে প্রতি মণ অপরিশোধিত লবণ ৬৫০ টাকায় বেচাবিক্রি হচ্ছে। কিন্তু কক্সবাজারের মাঠে প্রতি মণে ৩৮০ টাকা করে পাচ্ছেন তাঁরা। এর মধ্যবর্তী ২৭০ টাকা ব্যবধানের কারণ অনুসন্ধানের কেউ নেই।
লেমশিখালীর চাষি মামুনুল ইসলাম (৪৫) বলেন, দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে মণপ্রতি লবণের দাম আরও ৫০ টাকা বাড়ানো দরকার। সরকার চাইলে মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম ৪৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিতে পারে।
মহেশখালীর ধলঘাটা, মাতারবাড়ী, কুতুবজুম ইউনিয়নে এবং টেকনাফের সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, হ্নীলা, রঙিখালী, জাদিমুরাতে লবণ উৎপাদনের ধুম পড়েছে। এতে চাষিরা খুশি হলেও দাম বাড়া-কমা নিয়ে দুশ্চিন্তায় তাঁরা। কুতুবজুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, আসন্ন রমজানে লবণের দাম অনেক কমে যেতে পারে। তখন লোকসান দিয়ে লবণ বিক্রি করতে হবে—এই শঙ্কায় বহু চাষি উৎপাদিত লবণ মাটির নিচে গর্তে বা গুদামে মজুত করছেন।