মাদারীপুরে ৩ খুন: মামলা হয়নি, আটকও নেই; পুরুষশূন্য এলাকায় বাড়ছে আতঙ্ক

মাদারীপুরের কালকিনিতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে হাতবোমার আঘাতে তিনজন নিহত হন। গত শুক্রবার সকালে খাসেরহাট সেতুর নিচ পূর্বপাড় এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে বাবা-ছেলেসহ তিনজনকে হত্যার দুই দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো মামলা হয়নি। এ ঘটনায় আজ রোববার বেলা ১১টা পর্যন্ত অভিযুক্ত কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

এদিকে ঘটনার পর থেকে বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়ায় বাড়ছে আতঙ্ক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখনো ওই এলাকায় র‍্যাব, পুলিশ ও সেনাসদস্য মোতায়েন আছেন।

কালকিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবির আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্বজনদের পক্ষ থেকে থানায় এখনো কেউ এজাহার বা অভিযোগপত্র নিয়ে আসেননি। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ধরতে ‍পুলিশের অভিযান চলমান। তবে এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত বা হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকা মূলত জনশূন্য হয়ে পড়েছে। পুরুষ মানুষ নেই। নারীরা ঘর পাহারা দিচ্ছেন। আসামিদের ধরতে তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে তাঁদের অবস্থানস্থল ধরে অভিযান চলানো হচ্ছে। দ্রুতই আসামিদের ধরতে পারবেন বলে আশা ওসির।

শুক্রবার সকাল ছয়টার দিকে উপজেলার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের মধ্যেরচর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় হাতবোমার আঘাতে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) একজন সদস্য, তাঁর ছেলে ও একজন দিনমজুর নিহত হন। আহত হন আরও অন্তত ১০ জন। এ সময় বেশ কয়েকটি বসতঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।

নিহত ব্যক্তিরা হলেন মধ্যেরচর এলাকার মতিন শিকদারের ছেলে আক্তার শিকদার (৪২), আক্তার শিকদারের ছেলে মারুফ শিকদার (২০) ও খুনেরচর গ্রামের সিরাজুল চৌকিদার (৩৫)। আক্তার শিকদার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ছিলেন। আর সিরাজুল ছিলেন পেশায় কৃষক ও দিনমজুর।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মধ্যেরচর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ফকির ও শিকদার বংশের লোকজনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এলাকা ছাড়েন আওয়ামী লীগের নেতা আক্তার শিকদার। গতকাল শনিবার ভোরে শরীয়তপুরের নতুন বাজার এলাকা দিয়ে তিনি তাঁর লোকজন নিয়ে মধ্যেরচর এলাকায় প্রবেশ করেন, এমন খবরে এলাকায় মাইকিং করে লোক জড়ো করেন জলিল ফকিরের লোকজন। পরে আক্তার ও জলিলের লোকজন দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়ান। এ সময় বেশ কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করা হয়। হাতবোমার আঘাতে আক্তার শিকদার ঘটনাস্থলে নিহত হন। বোমায় গুরুতর আহত হন আক্তারের ছেলে মারুফ শিকদার। তাঁকে উদ্ধার করে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। বেলা ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান সিরাজুল চৌকিদার নামের আরেকজন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাঁশগাড়ী এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, শিকদার ও ফকির—দুই বংশের লোকজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। নিহত ইউপি সদস্য প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। কারণ, তিনি আগে ফকির বংশের লোকজনের ওপর হামলা-নির্যাতন করেছিলেন।

এদিকে শুক্রবারের ওই ঘটনার পর পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের খাসেরহাট, পূর্বপাড়, মধ্যেরচরসহ পাঁচটি গ্রাম প্রায় পুরুষশূন্য। আশপাশের পরিবেশও থমথমে। র‍্যাব, পুলিশ ও সেনাসদস্যদের টহল আছে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় আবার সংঘর্ষ বা লুটপাট এড়াতে অতিরিক্ত পুলিশ ও সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

মধ্যেরচর এলাকার মুদিদোকানি সোলাইমান ফকির বলেন, ‘তিন দিন ধরে দোকান বন্ধ। কোনো কাজ করতে পারছি না। এলাকার সবার মধ্যেই ভয়। আবার কখন মারামারি লাগে। বাড়ির মহিলারাও খুব আতঙ্কের মধ্যে আছে। আমরা এমন পরিস্থিতি দ্রুত সমাধান চাই। যারা অপরাধ করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করা হোক।’

তিন হত্যার ঘটনায় গতকাল মাঠপর্যায়ের তদন্তে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আবদুল মাবুদ। তিনি নিহত তিনজনের বাড়িতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেন। পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছে।

মোহাম্মদ আবদুল মাবুদ বলেন, ঘটনাটিকে অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এভাবে তিনজন মানুষকে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ফলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে বিষয়টি তদারক করা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে বিষয়টি অনুধাবনের জন্য আসা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সম্ভাব্য খুঁটিনাটি দেখা হচ্ছে। অপরাধী যেই হোক পুলিশি তদন্তে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। প্রত্যেক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হবে।

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ভাস্কর সাহা প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের ধরতে পুলিশের একাধিক দল কাজ করছে। আসামিরা কেউ এলাকায় নেই। তারা সবাই গা ঢাকা দিয়েছেন। আসামিরা যেন পালিয়ে না থাকতে পারেন, তার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন