৮৬৯ কোটি টাকা খরচে কী লাভ হলো, প্রশ্ন সিলেটবাসীর
ভারী বৃষ্টিতে সিলেট নগরে যেন জলাবদ্ধতা দেখা না দেয়, সে জন্য চলতি অর্থবছরে ২০৯ কোটি টাকার কাজ করছে সিটি করপোরেশন। আর গত ১২ বছরে এ খাতে খরচ হয়েছে ৮৬৯ কোটি টাকা। এত টাকা খরচের পরও জলাবদ্ধতার সমস্যা পুরোপুরি দূর হয়নি। চলমান বন্যা পরিস্থিতির কারণে জলাবদ্ধতার সংকট আরও বেড়েছে।
সিলেট নগরে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার পর থেকেই এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে জোর আলোচনা চলছে। ফেসবুকে অনেকেই লিখেছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি কর্তৃপক্ষ গত এক যুগে প্রকল্পের পর প্রকল্প গ্রহণ করেছে। অথচ নগরবাসী এর কাঙ্ক্ষিত সুফল পায়নি। এত টাকা খরচে তাহলে নগরবাসীর কী লাভ হলো, এ নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
সর্বশেষ ১২ ও ১৩ মে ভারী বৃষ্টিতে নগরের বেশ কয়েকটি এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সপ্তাহখানেক ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে নগরের ৩০টি এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
নগরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, যদি নদী ও ছড়াগুলো পরিকল্পিতভাবে আরও সুগভীর করার পাশাপাশি অবৈধ দখলমুক্ত করে খনন হতো, তাহলে নগরের বন্যা পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ রূপ পেত না। নগর দিয়ে প্রবাহিত ছড়া ও খালগুলো যথাযথ খননের অভাবে পানির ধারণক্ষমতা হারিয়েছে। এতে বন্যা পরিস্থিতি জটিল হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বৃহস্পতিবার সকালে দাবি করেন, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন নগরে জলাবদ্ধতা কম হয়। চলমান প্রকল্পের কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতা আর থাকবে না। আর এখন পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে নদীর পানি উপচে মূলত বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সুরমা নদী পানির ধারণক্ষমতা হারিয়েছে। তাই এটা খনন করা না হলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না।
সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নগরের ভেতর দিয়ে ১১টি ছড়া (প্রাকৃতিক খাল) প্রবাহিত হচ্ছে। এসব ছড়ার শাখাগুলো গিয়ে মিশেছে সুরমা নদীতে। ফলে বৃষ্টির পানি এসব ছড়া দিয়েই মূলত নদীতে গড়ায়। আবার ছড়াগুলোর ১৬টি শাখা খালও আছে। সব মিলিয়ে ছড়া ও খালের দৈর্ঘ্য ১১০ কিলোমিটার। অন্যদিকে নগরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাকা ড্রেন আছে ৬৫০ কিলোমিটার অংশে।
পরিবেশকর্মী, নগর–পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীদের মতে, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করছে ঠিকই, তবে পরিকল্পিতভাবে ওই টাকা খরচ হয়নি। কোথাও কোথাও ছড়ার উপরিভাগ ঢেকে ‘বক্স কালভার্ট’ নির্মাণ করে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহের গতিও রুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। জল দূর করার টাকা যেন জলেই গেছে। ফলে অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ কমেনি। এখন চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে সুরমা নদী পানিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকায় নগর দিয়ে প্রবাহিত ছড়া ও খালের পানিও নামতে পারছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, অপরিকল্পিতভাবে ছড়া সংস্কার করা হয়েছে। ছড়ার পাড় দখল করে হাজারো ব্যক্তি স্থাপনা বানিয়েছেন। অথচ এসব স্থাপনা ঠিকমতো উচ্ছেদ না করে গার্ডওয়াল দিয়ে ছড়াকে আটকে রেখে দখলদারদেরই স্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এসব ছড়া-খালও আবর্জনায় ঠাসা। তাই ভারী বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। খাল-ছড়ায় আবর্জনা ফেলা বন্ধে সিটি কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে।
নদীর বুকে পলি জমে জমে নদীর পানি ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে, শহরের পানিনিষ্কাশনের ড্রেনগুলোও অনুপযোগী। তা ছাড়া শহরের যত্রতত্র বৈধ-অবৈধ স্থাপনা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, এসব কিছুই পানি আবদ্ধতার জন্য দায়ী।
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা জানিয়েছে, বদরউদ্দিন আহমদ কামরান (প্রায়) মেয়র থাকাকালে ২০০৯ সালে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে কয়েকটি ছড়া (প্রাকৃতিক খাল) খনন করা হয় এবং ৫ কিলোমিটার এলাকায় রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ করা হয়। পরে আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র থাকাকালে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৩৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। এর অধীনে ছড়া দখলমুক্ত করে খনন করা হয়। পাশাপাশি ৩৯ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার রিটেনিং ওয়াল, ইউটাইপ ড্রেন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়। এর বাইরে দুটি ছড়ার কিছু অংশে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে করা হয়েছে বক্স কালভার্ট। চলতি বছর ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সাগরদীঘির পাড় এলাকার ছড়া খনন ও সংস্কারকাজ চলছে।
একই সূত্র বলছে, ছড়া খনন ও সংস্কারের পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য নগরের নালা-নর্দমা প্রশস্ত করা ও নির্মাণের কাজও সিটি কর্তৃপক্ষ করছে। ১২ বছরে এ খাতে কাজ হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার। চলতি বছরে নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে আরও প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাজ চলমান আছে।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পিতভাবে ছড়া খনন ও সংস্কার করা না হলে দুর্ভোগ কমবে না। ছড়ার উপরিভাগে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা সিটি কর্তৃপক্ষের ভুল ছিল। সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। নগরের পুকুর, দিঘি ও টিলা একের পর এক বিলুপ্ত হচ্ছে। এসব কারণও জলাবদ্ধতার জন্য উল্লেখযোগ্য।
সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন করে নগরে আর কোনো ছড়ায় বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকায় বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া ছড়ার তীর থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করেই গার্ডওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকা থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখন অতিবৃষ্টিতে কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা হলেও দ্রুত ওই পানি নেমে যায়।
নগরে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই ফেসবুকে অনেককে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিতে দেখা গেছে। সংগঠক দেবজ্যোতি দেবু লিখেছেন, ‘অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও উন্নয়নের ফলে শহরের ড্রেনেজ সিস্টেম জঘন্যতম খারাপ। অল্প বৃষ্টিতেই হাঁটুপানি হয়ে যায়। সংবাদকর্মীরা এসব বারবার তুলে ধরার পরও মেয়র সাহেব নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। পরিস্থিতির উন্নতি হয় না। নগরবাসীও যেন এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কারও মধ্যে কোনো বিকার নেই।’
সমাজকর্মী ও উদ্যোক্তা খায়রুন নাহার চৌধুরী লিখেছেন, ‘নদীর বুকে পলি জমে জমে নদীর পানি ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে, শহরের পানিনিষ্কাশনের ড্রেনগুলোও অনুপযোগী। তা ছাড়া শহরের যত্রতত্র বৈধ-অবৈধ স্থাপনা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, এসব কিছুই পানি আবদ্ধতার জন্য দায়ী। দ্রুত কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে সামনের দিনগুলোতে ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে।