৫৮৪ কোটি টাকার প্রকল্পে ধীরগতি

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার পাকেরদহ থেকে শনপচা পর্যন্ত ৬ দশমিক ২৫ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে।

শুষ্ক মৌসুমেও যমুনা নদীর বাঁ পাশের তীরে প্রবল ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি। সম্প্রতি বগুড়ার সারিয়াকান্দির পাকুরিয়ার চরে
ছবি: প্রথম আলো

বসতভিটাসহ ৩২ বিঘা জমির মালিক ছিলেন বগুড়ার সারিয়াকান্দির পাকুরিয়ার চরের বাসিন্দা সাহেব আলী। সংসারে ছিল সচ্ছলতা। এখন সব হারিয়ে নিঃস্ব তিনি। যমুনা নদীর ভাঙনে চর বিলীন হওয়ার পর থাকার মতো জায়গাটুকু নেই তাঁর। পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকছেন নদীর ওপারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর বেড়ার ঘর তুলে।

একই এলাকায় বসতবাড়িসহ ফসলি জমি ছিল মেহের আলীর (৬৫)। জমিজমা ও বসতভিটা নদীতে হারিয়ে তিনি এখন পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছেন নদীর ওপারে সোনাতলা উপজেলার পাকুল্যা এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধে।

কয়েক দিন আগে পাকুরিয়ার চরের খেয়াঘাটে কথা হয় মেহের আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালের বন্যার পর থেকে ২৩ দফা বসতবাড়ি ভেঙেছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ৫২ বিঘা আবাদি জমি। ২০১৫ সালে শেষ সম্বল বসতভিটাও নদীতে ভেঙে যায়। কূলকিনারা না পেয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ওঠেন সোনাতলা উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে।

শুধু সাহেব আলী বা মেহের আলী নন, যমুনা নদীর প্রবল ভাঙনে তাঁর মতো অসংখ্য পরিবার এখন বাস্তুহারা। একসময় চরের সচ্ছল কৃষক হয়েও এখন সহায়-সম্বলহীন তাঁরা।

ব্রহ্মপুত্র থেকে বয়ে আসা যমুনা নদী বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মার দিকে। আর যমুনা নদীর তীরবর্তী দুর্গম চর সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটবাড়ি, দলিকা, মানিকদাইড় থেকে পাকুরিয়ার চর হয়ে ধারাবর্ষার চর পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশে কয়েক বছর ধরে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

শুষ্ক মৌসুমে যমুনার তীব্র ভাঙনের কবলে পড়েছে টেংরাকুড়া থেকে পাকুরিয়া হয়ে শনপচার চর পর্যন্ত অংশ। ভাঙনে দিশেহারা মানুষ বসতভিটা সরিয়ে নিলেও, ভাঙছে আবাদি জমি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বর্ষা মৌসুমে যমুনার ভাঙনে বিলীন হয়েছে চর হাটবাড়ি, চর দলিকা, উত্তর শিমুলতাইড় চর, চর বহলাডাঙা, সুজনের পাড়া, কাকলিহাতা, চকরতিনাথ, শিমুলবাড়ি, কাকালিহাতা, কাশিরচর, চকরথিনাথ, নোয়ারপাড়া ও দীঘাপাড়া। আংশিক বিলীন হয়েছে মানিকদাইড় চর, জামথল চর, বেড়া পাঁচবাড়িয়া, উত্তর টেংরাকুরা, দক্ষিণ টেংরাকুড়া, চর ঘাগুয়া, শনপচার চরসহ আরও কয়েকটি চর। গত দুই বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙনে এসব চরের অন্তত ১০ হাজার বসতভিটা এবং কয়েক হাজার একর আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

এ বছর বর্ষা শুরুর আগেই নতুন করে যমুনা নদীর বাঁ পাশের তীরে প্রবল ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চরাঞ্চলের লোকজন। অনেকের বসতভিটা ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। এখনো যাঁদের ঘরবাড়ি নদীর তীরে আছে, তাঁরা আছেন আতঙ্কে। কারণ, যেকোনো সময় বসতঘর ও জমি নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন ভাঙনকবলিত চরের মানুষ।

গত শনিবার সরেজমিন যমুনা নদীর বাঁ তীর ধরে শনপচার চরের খেয়াঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে কাজলা ইউনিয়নের জামথল খেয়াঘাট পর্যন্ত ভাঙনকবলিত এলাকায় যান এই প্রতিবেদক। যমুনায় প্রবল স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। এতে তীরের মাটি ও বালুর স্তূপ ধসে পড়ছে নদীতে। বিলীন হচ্ছে তীরবর্তী ফসলি জমি ও শত বছরের লোকালয়। ভাঙনের ভয়াবহ চিত্র সবচেয়ে বেশি পাকুরিয়া ও টেংরাকুড়া চরে। যমুনার প্রবল ভাঙনে এই চরের কয়েক শ একর আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে।

কাজলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সাজাহান আলী বলেন, যমুনার ভয়াবহ ভাঙনে পাকুরিয়ার চর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। গত চার বছরে এই চরের প্রায় দুই হাজার একর আবাদি জমি, ৫০০ বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় পাকুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়েছে।

যমুনার বাঁ তীর রক্ষায় গত অর্থবছরে পাউবো জামালপুর কার্যালয় থেকে ৫৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে তীর রক্ষায় একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ভাঙনরোধে সারিয়াকান্দি উপজেলার পাকেরদহ থেকে কর্ণিবাড়ী ইউনিয়নের শনপচা পর্যন্ত ৬ দশমিক ২৫ কিলোমিটার যমুনা নদীর বাঁ তীর সংরক্ষণ প্রকল্প বা বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয় গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। তবে কাজের ধীরগতিতে হতাশ যমুনার তীরবর্তী চরাঞ্চলের মানুষ।

জামালপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ বলেন, যমুনার বাঁ তীর রক্ষায় গত অর্থবছরে ৫৮৪ কোটি টাকার তীর রক্ষা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই এ প্রকল্পের ২৫ শতাংশ কাজ শেষ। ২০২৩ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। প্রকল্পের অধীনে নদীর তীরে প্রায় ১৫ লাখ জিওটেক্স বিছিয়ে এর ওপর প্রায় ৪৬ লাখ সিসি ব্লক বসানো হবে।

অর্থ ছাড়ের জটিলতায় প্রকল্পের ধীরগতি হচ্ছে দাবি করে মোহাম্মদ আবু সাঈদ বলেন, প্রকল্পের ২৫ শতাংশ; অর্থাৎ প্রায় ১৫০ কোটি টাকার কাজ শেষ হয়েছে। অথচ এ পর্যন্ত প্রকল্পের অর্থ ছাড় হয়েছে

৬৭ কোটি টাকা। ঠিকমতো অর্থ ছাড় হলে কার্যাদেশের মেয়াদ শেষের আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব।